অধিকাংশ মামলায় হেরে যায় দুদক

অভিযোগ পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধানে সন্তোষজনক ফল মিললেই কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু তাই নয়, মামলার পর তদন্তে যদি সেই অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই দেয়া হয় চার্জশিট। এত ধাপ সম্পন্ন করেও অধিকাংশ মামলায় হেরে যায় দুদক। এতে আদালতের রায় নিয়ে দুর্নীতিমুক্ত হচ্ছেন ‘চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা’। এ তলিকায় রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তিও। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্বল তদন্ত, সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত না করানো, আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বিচারের সময় মামলার পিপিদের মনোযোগ না থাকার কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং তদন্তের ভুলত্রুটি চিহ্নিত হওয়ার পরও তা বিচারের সময় সংশোধনের উদ্যোগ না নেয়ার কারণেও কোনো কোনো সময় মামলার রায় আসামিদের পক্ষে চলে যায়। তবে নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকায় মামলা পরিচালনায় চুক্তিতে নিয়োজিত দুদক আইনজীবীদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। দুদক ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ৮০ শতাংশ মামলায় হেরেছে দুদক। এছাড়া ২০১২ সালে ৬৮ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৫৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৬৩ শতাংশ ও ২০১৬ সালে ৪৬ শতাংশ মামলার রায় আসামির পক্ষে গিয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ মামলায় আসামির সাজার হার কম হওয়ার বিষয়টিকে তাদের নিজেদের এক ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে মনে করছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সাজার হার শতভাগে উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের দুদকের আইনের ৩৩ বিধিতে নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের কথা বলা আছে। তবে দুদক থেকে এখনও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি দুদকের প্রস্তাবিত সাংগঠনিক কাঠামোতেও এ পদের বিষয়ে কিছু বলা নেই। এ প্রসঙ্গে দুদক কমিশনার ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট করার বিষয়টি আমাদের চিন্তাভাবনায় আছে। কারণ এ বিষয়টি দুদক আইনেও আছে। তবে আমাদের ভাবতে হবে আইনজীবী পাওয়া যাবে কিনা। এ ছাড়া এর সঙ্গে সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতাও আছে। এগুলো সব দেখে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
হেরে যাওয়া কয়েকটি মামলার রায়
কেন মামলাগুলোয় দুদক হেরে যায়, তার কারণ ফুটে উঠেছে গত দুই বছরে নিষ্পত্তি হওয়া চার ধরনের দুর্নীতির কয়েকটি মামলার রায়ের কপিতে। এতে তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক আইনজীবীদের গাফিলতির একটি চিত্রও সুস্পষ্ট হয়েছে। নিচে এসব মামলার রায় ও আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়র বোর্ডের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একেএম আলী আজমের বিরুদ্ধে ১২ লাখ ৮০ হাজার ৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছিল দুদক। মামলা দায়েরের পর তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আলী আজমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরপর প্রায় দুই বছর পর ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল আসামির বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় চার্জ গঠন করা হয়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি (বিচার শুরুর ৫ বছর পর) ঢাকার ৪নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আতাউর রহমান মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে দুদক থেকে আনীত অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থতায় আসামি আলী আজমকে খালাস দেয়া হয়। আলী আজমকে খালাস দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, দুদকের প্রসিকিউশন ৫ জন সাক্ষী আদালতে হাজির করে। এর মধ্যে দুদকের মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাও রয়েছেন। রায় থেকে জানা যায়, আলী আজমের সঙ্গে বিরোধ ছিল সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির। তিনি ২০০৭ সালে আলী আজমের বিরুদ্ধে দুদকে একটি অভিযোগ করেন। তার অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য নিয়ে আলী আজমের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয় দুদক। তার ভিত্তিতেই মামলাটিও দায়ের করা হয়।
বিচার চলাকালে আসামিপক্ষ আদালতকে জানায়, আলী আজমের ২০০৭-০৮ করবর্ষে আয়কর নথিতে অর্জিত আয় ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৭৭ টাকা প্রদর্শন করলেও দুদক কর্মকর্তা তা কমিয়ে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ২৭৭ টাকা দেখিয়েছেন। একইভাবে ২০০৮-০৯ করবর্ষে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৮ টাকা কম দেখিয়েছেন। এভাবে তার প্রদর্শিত বৈধ আয় ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ১২২ টাকা বিবেচনায় না নিয়ে ১২ লাখ ৮০ হাজার ৩৪ টাকার আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা করেছেন। রায়ে বলা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তা কেন আসামির আয় কম দেখিয়েছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা তদন্ত প্রতিবেদনে দেননি। এমনকি সাক্ষীর সাক্ষ্যেও কোনো বর্ণনা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। ফলে আসামির আয় কম দেখানো বেআইনি ও কর্তৃত্ব বহির্ভূত। রায়ে আরও বলা হয়, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য এবং তাদের প্রতিবেদনে আসামির নিট আয় দেখানো হয়েছে ৫০ লাখ ১ হাজার ৭৩৬ টাকা। অথচ তার সম্পদের পরিমাণ ৬২ লাখ ৮১ হাজার ৭৯৯ টাকা। তদন্ত প্রতিবেদনে আসামির ১২ লাখ ৮০ হাজার ৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে মর্মে দুদক থেকে অভিযোগ আনা হলেও তা বিচারে প্রমাণিত হয়নি বলে বিচারক তার রায়ে উল্লেখ করেন। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। মামলার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আসামি আলী আজমকে খালাস দেয়া হয়। দুদকের পক্ষে নিয়োজিত পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে যাব। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মামলা প্রমাণের। তারপরও বিচারক যে রায় দিয়েছেন তা মেনে নিতে হচ্ছে। কারা অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী আবদুল হকের বিরুদ্ধে ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আবদুল হক কারা অধিদফতরের স্টেশনারি শাখার দায়িত্বে থাকাকালীন তেজগাঁও মুদ্রণ লেখসামগ্রী ফরম ও প্রকাশনা অধিদফতর থেকে স্টেশনারি মালামাল বুঝে নিয়ে তা কারা অধিদফতরে জমা না করে বিক্রি করে ওই অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়। দুদকের মামলার আগে আবদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়। এ সময় তাকে আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য বলা হলেও তিনি তা করেননি।
দুদক তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ৮ আগস্ট আবদুল হকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। তদন্তে তার বিরুদ্ধে ৪ লাখ ২৭ হাজার ১৩৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ‘প্রমাণিত’ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলায় বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে বিচারক ২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আবদুল হককে খালাস দেন ঢাকার ৪নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আমিনুল হক। রায় দেয়ার আগে বিচারক তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দেন। আসামি আবদুল হক স্টেশনারি মালামালের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কিনা, প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন কিনা এবং আসামির বিরুদ্ধে আনীত ধারায় তিনি শাস্তি পাবেন কিনা। বিচার চলাকালীন বিচারক ১২ জনের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করেন। এর মধ্যে ৭ জনই হলেন কারা অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের অনেকেই সাক্ষ্য প্রদানকালে আবদুল হকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের কথা শুনেছেন বলে বক্তব্য দেন। তবে তারা বলেছেন, আবদুল হক চাহিদা মাফিক স্টেশনারি মালামাল অফিসে জমা করতেন। তিনি সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ বলেছেন, আত্মসাতের বিষয়ে শুনলেও এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানেন না। বিচারক বলেন, শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে ন্যায়বিচার বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলে সবাই জেনে থাকেন।
আবদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও আত্মসাতের অভিযোগে তাকে দায়ী করা হয়নি। বরং বেআইনিভাবে অফিসে অনুপস্থিত থাকার কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। দুদকের প্রসিকিউশনও তাদের তদন্ত কিংবা আদালতে আনা সাক্ষীদের কাছ থেকে আবদুল হকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি তারা অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক শুনানির সময় সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আদালতে দিতে পারেনি। স্টেশনারি মালামাল সম্পর্কিত স্টক রেজিস্টারের বিষয়ে আসামি আবদুল হককে দায়ী করা হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি। আসামির বিরুদ্ধে স্টেশনারি মালামাল উত্তোলন করে অফিসে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করার ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি। ফলে তাকে অভিযোগের দায় থেকে খালাস দেয় হল। কমলাপুর আইসিডির ইন্সপেক্টর (প্রিভেন্টিভ শাখা) আবুল হাসেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ২০০৮ সালে জনৈক আমদানিকারক তাকে ২ হাজার টাকা (৫০০ টাকার চারটি নোট) ঘুষ দিতে বাধ্য হন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ের সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আবুল হাসেমের অফিস তল্লাসি করে মানিব্যাগ থেকে ৪ হাজার ৬৮২ টাকা উদ্ধার করেন। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, রাসেল নামে এক যুবকের কাছ থেকে ৬ হাজার ৫২০ টাকা ও তার অফিস কক্ষের পাশের গুদাম ঘরে পুরনো স্টিলের ফাইল কেবিনেট থেকে ৫৮ হাজার ৪০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই টাকাসহ তাকে আটক করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে মামলা করে দুদক। ঢাকার ২নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হোসনে আরা বেগম ২০১৬ সালের মার্চে এ মামলার রায়ে আসামি আবুল হাসেমকে খালাস দেন। বিচারক তার রায়ে বলেন, মামলার বিচার চলাকালীন ঘুষের চারটি ৫০০ টাকার নোটের ফটোকপি সম্পর্কে মামলার বাদী কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেন। বাদী তার এজাহারের সমর্থনে বক্তব্য দিলেও আইনজীবীদের জেরায় তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট তিনি কমলাপুর আইসিডির প্রিভেন্টিভ কক্ষে যাননি।
এজাহারে যে আমদানিকারকের মাধ্যমে ঘুষ প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই আমদানিকারককে তদন্তকালে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাও আদালতে বলেছেন, মামলার বাদী ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না। রায়ে বলা হয়, জব্দ তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ঘটনা সংবলিত নথি-৫ জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই নথি আদালতে দাখিল বা উপস্থাপন করেননি। ঘটনার সময় উপস্থিত আইসিডির যুগ্ম কমিশনার ওয়াহিদা রহমান তার জবানবন্দিতে জব্দকৃত আলামত হিসেবে নথি ও টাকা তার জিম্মায় থাকার কথা বললেও পরে জানান ওই নথি ঢাকার কাস্টম হাউসের কমিশনার বরাবর পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কাস্টম হাউস থেকে কোনো দালিলিক নথি সাক্ষ্য হিসেবে এ মামলায় প্রেরণ করেনি। বহিরাগত রাসেলের কাছ থেকে এবং স্টিলের ক্যাবিনেট থেকে ঘুষের টাকা উদ্ধারের বিষয়টি পরোক্ষ, মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ হয়নি। সার্বিক বিচার বিবেচনায় বিচারক আসামি আবুল হাসেমকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। এরকম অসংখ্য মামলায় দুদকের হেরে যাওয়ার রেকর্ড আছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। কিন্তু কেন ‘অকাট্য তথ্যপ্রমাণের’ ভিত্তিতে মামলা করেও দুদক হেরে যাচ্ছে- এমন প্রশ্নে দুদকের এক পিপি যুগান্তরকে বলেন, বাইরে থেকে অনেক কথাই শোনা যায়। কিন্তু আমরা যখন বিচার শুনানি করি,
তখন দেখতে পাই মামলাভেদে ক্ষেত্রবিশেষ কিছু অসংগতি থেকে যায়। আবার সাক্ষীরা এসে আদালতে সত্য প্রকাশ করতে চান না। অনেকে আবার সাক্ষ্য দিতেই আসেন না। সম্পদের মামলার ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগ যে সম্পদ বৈধ ঘোষণা করে তার সপক্ষে আসামিপক্ষ থেকে জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিচার দীর্ঘায়িত হলে অনেক আলামত আবার নষ্টও হয়ে যায়। তিনি বলেন, কাউকে হয়রানির জন্য মামলা হচ্ছে কিনা, সেদিকেও নজর দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সংজ্ঞাও ঠিক করা উচিত। বিচারিক আদালতে হেরে যাওয়া মামলার বিষয়ে দুদক কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম বলেন, আমরা এ ধরনের মামলায় ‘মেরিট’ বিবেচনায় আপিল করে থাকি। তিনি বলেন, আমরা মামলায় কেন হেরে যাচ্ছি, তার কারণ আইনজীবীদের কাছ থেকেও জানার চেষ্টা করছি। প্রাপ্ত ভুলত্রুটির যাতে পুনারাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনার জন্য তাদের বলা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, যেসব মামলায় দুদক জিতেছে, সেগুলোয়ও আবার আসামিরা আপিল করে থাকে। আমাদের সেসব মামলারও শুনানি করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুদক যেসব মামলায় বিচারিক আদালতে হেরে যায়, তার অর্ধেক মামলায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল আপিল করে থাকে। অন্যদিকে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরাও তাদের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে থাকে। রিট, ক্রিমিনাল আপিল ও ক্রিমিনাল রিভিশনসহ বর্তমানে উচ্চ আদালতে ২ হাজার ৯৭০টি দুর্নীতি মামলার বিচার নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৮৯টি ক্রিমিনাল মিসকেস, ৯২৪টি রিট,
৩৬৭টি ক্রিমিনাল আপিল (সাজা ও খালাসের বিরুদ্ধে আপিল) ও ২৯০টি মিসকেস রয়েছে। তবে ২০০৯ সালের আপিলের নিষ্পত্তি এখনও শেষ হয়নি। দুদকের কাছে থাকা সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, আসামিরা দুদকে কার্যক্রমের বিরুদ্ধে যেসব রিট মামলা করেছে, তার ৮০ ভাগ রিটে দুদক জিতেছে। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের সাজা ও খালাসের রায় হাইকোর্টে বহাল রয়েছে ৭০ ভাগ মামলার। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলা করেও দুদক কেন হেরে যাচ্ছে- এমন প্রশ্নে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি বলব, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দুদক বেশিরভাগ মামলায় হেরে যাচ্ছে। বিচার বিলম্বিত হলে সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না, মামলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাভিডেন্স নষ্ট হয়ে যায়। যিনি অনুসন্ধান বা তদন্ত করেছেন দেখা গেল তিনি অবসরে চলে গেছেন।’ গোলাম রহমান বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তার কাজে ফাঁকফোকর রাখা হলে এর প্রভাবও বিচারে পড়ে। হয়তো ওপরের চাপে তিনি আদালতে একটা প্রতিবেদন দেন। কিন্তু তদন্তে ত্রুটি থাকলে আসামিরা সেই সুযোগটিও পায়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দুদকে এ মুহূর্তে প্রয়োজন ভালো আইনজীবীদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ প্যানেল। তাদের দিয়ে দুর্নীতির মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে দুদক লাভবান হবে বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া টিআইবির ট্রাস্টির সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, দুদকের নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট থাকা দরকার। এটা করা হলে আইনজীবীদের জবাবদিহিতা বাড়বে। দুদক কেন তাদের মামলায় হেরে যায়, সে বিষয়টিও কমিশনকে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.