এখানে সেখানে- নতুন বছরের শোভাযাত্রা by আ স ম মাসুম

এলিজাবেথ টাওয়ারের (বিগ বেন) ঘড়িতে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল। জানান দিল ভোর ছয়টা। ২০১৩ সালের প্রথম সকাল। নিচে অপেক্ষায় আছি আমি আর সুভাষদা। আমরা এসেছি এখানে নিউ ইয়ার প্যারেড, মানে নতুন বছরের শোভাযাত্রা সরাসরি সম্প্রচার করার কাজে।
লাইভ অনুষ্ঠানটি দুপুর ১২টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সম্প্রচার হবে বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে। দক্ষ ক্যামেরাম্যান সুভাষদা চার বছর ধরে বিবিসির সঙ্গে কাজ করছেন চুক্তিভিত্তিক। আমার এত বড় পরিসরে কাজ করার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ভোরের আলো তখনো ফোটেনি, এর মধ্যেই লাইভ ট্রান্সমিশনের জিনিসপত্র চলে এসেছে। আমরা সবাই তিন ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু তৈরি করে ফেললাম। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে শুরু হলো ন্যাশনাল প্যারেড। গ্রিনপার্ক আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে শুরু হয়ে ট্রাফালগার স্কয়ার হয়ে ওয়েস্টমিনস্টার পার্ক পর্যন্ত বিশাল এলাকা। লক্ষাধিক মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে নতুন বছরের সূচনা করছে। আমি ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত, যেখানে র্যা লি শুরু হবে, সেখানে। প্রথম শটটি শুরু হবে আমার ক্যামেরা থেকে। সঙ্গে থাকা টকব্যাকে অনুষ্ঠানটির পরিচালক স্টিভের কাউন্টডাউন শুরু হলো। ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো, গো...। এসে পড়েছে শোভাযাত্রার প্রথম দলটি—ফাস্ট ইবস্টক স্কাউট ব্যান্ড। এরপর নানা সাজে, নানা ভঙ্গিমায় প্রবেশ করতে লাগল নানা সংগঠন, লন্ডনের নানা কাউন্সিল। সারা পৃথিবীকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে এই র্যা লিতে। মোট ৭০টি দল এভাবে নেচে-গেয়ে অংশ নিয়েছে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে। এর মধ্যে বেশ কিছু সংগঠন নজর কাড়ল—যেমন ডাঙ্কি ব্রেড সোসাইটি। এটি ১৯৬৭ সালে চালু হয়। এখন এর সদস্যসংখ্যা এক হাজার আর নিবন্ধিত গাধা হচ্ছে এক হাজার ৫০০! বেশ হেলেদুলে গাধাগুলো যাচ্ছে মূল প্যারেডের দিকে এগিয়ে। আর গাধাগুলোর মালিক যাঁরা, তাঁরাও গর্বিত ভঙ্গিতে যাচ্ছেন এগুলোর সঙ্গে। এর মধ্যে চলে এলেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ! রথে বসেছেন তিনি। উপস্থাপক রানির উপস্থিতি ঘোষণা করতেই সব চোখ ঘুরে গেল রানির দিকে। তবে তিনি ছিলেন রানির ‘লুক অ্যালাইক’, মানে রানির সাজে নকল রানি! দর্শকদের আগ্রহে তাতে অবশ্য ভাটা পড়ল না।
এবার সবাই নড়েচড়ে দাঁড়ালেন! কারণ, উপস্থাপক ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে একসঙ্গে ২০০ আমেরিকান চিয়ার গার্লস নেচে-গেয়ে ঢুকল।
এনফিল্ড ব্যালি ড্যান্স গ্রুপও আলোড়িত করল দর্শকদের। অ্যারাবিয়ান ব্যালি ড্যান্স ব্রিটেনের রাস্তায়! ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে হঠাৎ দেখি, আকাশে উড়ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আবার দেখি একটি ড্রাগন! চোখ সরিয়ে দেখি পৃথিবীর নানা দেশকে ঘুড়ির মধ্যে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে একটি সংগঠন!
তারপর সবচেয়ে বড় চমক! বাংলাদেশের রিকশা! একটি সংগঠন তাদের সঙ্গে রেখেছে বাংলাদেশের চারটি বর্ণিল রিকশা! একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমাকে গর্বিত করল। টকব্যাকে শুনলাম অনুষ্ঠানের ডিরেক্টর স্টিভ মজা করে বলছেন, ‘মাসুম, তুমি চাইলে ক্যামেরা ছেড়ে রিকশায় চড়ে আসতে পারো।’ রাস্তার পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন বাংলাদেশিও চিৎকার করে স্বাগত জানাল রিকশাকে। আমি ক্যামেরা ছেড়ে ছবি তুলতে সঙ্গে থাকা মুঠোফোন বের করলাম, একটু কি হাত কেঁপে উঠল আবেগে! হয়তো। আমার জন্মশহর মেঘ-পাহাড়ের দেশ, গ্রামীণ পটভূমির শহর সুনামগঞ্জে রিকশায় চড়ে বেড়ানো প্রতিটি দিন বিকেলের প্রিয় কাজ ছিল।
এলিজাবেথ টাওয়ারের ঘণ্টাধ্বনি দিয়ে শুরু হয় প্রতিটি বছর নতুন একটি দিনের। ১২টি ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে পুরো আলোক ফোয়ারায় মেতে ওঠে পুরো ওয়েস্টমিনস্টার এলাকা। আর নতুন বছরের প্রথম দিবসের এ আয়োজনটি ২৫ বছর ধরে ব্রিটেনের কৃষ্টি-কালচারকে মানুষের সামনে নিয়ে আসে। এবার সেই ব্যাপ্তি ছড়িয়ে গেল বিশ্বব্যাপী।

No comments

Powered by Blogger.