সুদূরপ্রসারী বিস্তৃত ও তৎপর কূটনীতি by মেহেদী হাসান

ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক শক্তির তুলনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে অনেক বেশি প্রভাব রাখে বাংলাদেশ। এ দেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্ব দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে এ দেশ সোচ্চার। বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশ আজ অনুকরণীয়। গত চার বছরে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ- সর্বত্রই ছিল বাংলাদেশের তৎপরতা।
এগুলোর অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত ফল এসেছে। আবার অনেক দেশের সঙ্গে সুদূরপ্রসারী সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সংঘাত- এসব ঘটনায় বিদেশিদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্ব শান্তি : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পররাষ্ট্রনীতি অনুচ্ছেদে প্রথম স্থান পেয়েছিল বিশ্ব শান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের কথা। জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শান্তি উদ্যোগে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় অংশীদার। এ দেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের সংঘাতময় অনেক এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছেন। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তির মডেলও গ্রহণ করেছে।
স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি : সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়- এ নীতির আলোকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের কথা রয়েছে আওয়ামী লীগের দিন বদলের সনদে। কূটনীতিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক সুস্পষ্ট লক্ষ্য বা পরিকল্পনা থাকা উচিত। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে যায় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। বর্তমানে এ বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে।
ভারত : বর্তমান সরকারের আমলে এককভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ভারত। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময় ও বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটলেও তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়া এবং স্থল সীমান্ত চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হওয়ার অপূর্ণতা রয়ে গেছে। সীমান্ত হত্যার সংখ্যা কমেছে। তবে এটি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
নেপাল ও ভুটান : উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যৌথভাবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে।
পাকিস্তান : মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশংসতা ও গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। ঐতিহাসিক এ ইস্যুটির দ্রুত নিষ্পত্তি দুই দেশের সম্পর্কে গতি আনতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮-এর সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশ না নেওয়ার বিষয়টি উভয় দেশেই আলোচিত হয়েছে।
মিয়ানমার : ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ফলে এ বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিনের বিরোধের অবসান হয়েছে। ওই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রোহিঙ্গা সমস্যা। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দেশটি আশ্বাস দিলেও তার বাস্তবায়ন এখনো প্রক্রিয়াধীন।
আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য অন্যান্য দেশ : গত চার বছরে বাংলাদেশ সার্ক, বিমসটেক ও ডি-৮-এর অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালিয়েছে। মালদ্বীপে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে কমনওয়েলথের উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিল বাংলাদেশ।
উন্নয়ন সহযোগী : আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া রাশিয়া, চীন ও আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সঙ্গে অধিকতর যোগাযোগ ও নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গত চার বছরে বাংলাদেশের দিক থেকে চেষ্টা অব্যাহত ছিল। উন্নয়ন সহযোগিতাও এসেছে। তবে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুতে টানাপড়েনও দেখা গেছে। গ্রামীণ ব্যাংকে যোগ্য নেতৃত্ব, সুশাসন, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, হত্যা, গুম, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রভৃতি ইস্যুতে অনেক ক্ষেত্রে দাতা দেশগুলো প্রশ্ন তুলেছে। অনেক দূতিয়ালির পরও পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে প্রত্যাশিত ফল এখনো আসেনি।
রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত বছর মে মাসে বাংলাদেশ সফর করেছেন। ওই সময় স্বাক্ষরিত অংশীদারি সংলাপের ঘোষণা অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বরে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে প্রথম বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র- উভয়েই বিদ্যমান সম্পর্ককে চমৎকার বলে অভিহিত করেছে।
শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যা, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া, শ্রম অধিকারসহ নানা ইস্যুতে দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাপান, কানাডা ও চীন : বর্তমান সরকারের আমলে দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময় হয়েছে। গত বছর মে মাসে জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদার বাংলাদেশ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরো বেগবান করেছে। জাপানের বিশ্বখ্যাত হোন্ডা কম্পানি এ দেশে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
গত বছর বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্য দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ কানাডাকে একাধিকবার অনুরোধ করলেও মৃত্যুদণ্ডবিরোধী নীতির কারণে দেশটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা (অনুদান) চুক্তিসহ বেশ কটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্য, আরব ও মুসলিম দেশ : বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালিয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল জোরালো।
আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা : আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠিয়ে সরকার গত চার বছরে ওই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের সম্ভাবনা যাচাই করে ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতিবাদ : ২০১১ সালে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে কিশোরী ফেলানী নিহত হওয়ার পর ঢাকায় তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। গত ২৩ জুন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টেরভেলে ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠকের পর এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ত্যাগের পর পরই এ দেশে জার্মানির দূতকে তলব করে গিডো ভেস্টেরভেলের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে তুরস্কের একটি বেসরকারি প্রতিনিধিদলের আগমন পরবর্তী (অন-অ্যারাইভাল) ভিসার অপব্যবহার বিষয়ে ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ব্যাখ্যা চায় বাংলাদেশ। সীমান্তে হত্যা ও অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণ ইস্যুতেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর : চার বছরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির শতাধিকবার বিদেশ সফর নিয়েও বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হয়েছে। তবে সফরগুলো প্রয়োজন ছিল বলেই তাঁর দপ্তর থেকে দাবি করা হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে মামলায় তিনিও আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে কমনওয়েলথ মিনিস্টারিয়াল অ্যাকশন গ্রুপের (সিম্যাগ) ৩৮তম সম্মেলনে ডা. দীপু মনি ওই গ্রুপের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

No comments

Powered by Blogger.