শিক্ষকদের কোন্দল আর ছাত্র সংঘর্ষে বিদায়ী বছরে জাবি ছিল অস্থির by আহমেদ রিয়াদ ও জাবি

বিদায়ী বছর ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অস্থির সময় পার করেছে। শিক্ষকদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও অন্তর্কোন্দল, উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনসহ ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনায় বছরজুড়েই নানা আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটিতে বছরের বেশির ভাগ সময় ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত থাকে।
একের পর এক চলা শিক্ষকদের নানামুখী আন্দোলন ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একের পর এক বিতর্কিত কার্যকলাপ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফেলে দেয় অনিশ্চয়তায়। মাঝপথে আবার বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠে নিয়োগে অনিয়ম ও প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ ও তা নিয়ে শিক্ষক সমাজের আন্দোলন, ক্লাস ধর্মঘট ও অবরোধের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে অস্থিরতা। এ অস্থিরতা উপাচার্যের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেন। আসেন নতুন উপাচার্য। স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উপাচার্য নিযুক্ত হন। এ নিয়েও প্রতিষ্ঠানে নানা মতাদর্শের শিক্ষকদের অসন্তোষ বাড়ে দিনে দিনে। চলে অচলাবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে বছরটি শেষ হয় সেশনজটের মধ্য দিয়ে। গত এক বছরে ছাত্রদলের নেতাকর্মীর ওপর ৫ বার হামলা করা হয়। এ অবস্থা সৃষ্টির পেছনে মূলত ছাত্র-শিক্ষক, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করেছেন দেশের শিক্ষাবিদরা।
বছরের শুরুতেই ছাত্রলীগ কর্মী নিহত ॥ গত বছরের শুরুতে ৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ইংরেজী বিভাগের চতুর্থবর্ষের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে একই সংগঠনের কর্মীরা ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা কেন্দ্রের পেছনে জঙ্গলে নিয়ে বেদম প্রহার করে। পর দিন ভোরে রাজধানীর বেসরকারী একটি হাসপাতালে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে প্রাথমিকভাবে তিনজনকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এক বছরের বহিষ্কারের শাস্তি হওয়ায় ফুঁসে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জুবায়ের হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৮ ছাত্রকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। তবে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে থাকা শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যাননি। জুবায়ের আহমেদ ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়ে নিহত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ২৯ মার্চ শিক্ষক সমিতির সভায় আলোচনার একপর্যায়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুন তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক আরজু মিয়ার কাছে লাঞ্ছিত হনÑ এমন অভিযোগের খবর উত্তাপ বাড়ায় ক্যাম্পাস পরিস্থিতিতে। এরপর দিন যত গড়ায় ততই পাল্টে যায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি। একসময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বৃহদাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকারীদের প্রশ্রয় ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে উপাচার্য ও প্রক্টরের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন করে। সপ্তাহ ব্যবধানে প্রক্টর পদত্যাগ করেন। বদলি করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা অফিসারকে।
শিক্ষকদের অপরাজনীতি ॥ এরপর মার্চে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন সামনে রেখে ৩২ জনকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দিলে ভিসিবিরোধী আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী ও কিছু সাধারণ শিক্ষক শিক্ষক সমাজের ব্যানারে প্রতিবাদ শুরু করেন। ফের আন্দোলন শুরু হয় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে। এক মাসেরও বেশি সময় চলে কর্মসূচী, ক্লাস পরীক্ষা বর্জন, অবরোধ। ফলে ক্রমেই ঘোলাটে হয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি। অচল হয় ক্যাম্পাস। সঙ্কট নিরসনে দেনদরবার গড়ায় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ পর্যন্ত।
সাংবাদিকদের কর্মকা-ে হস্তক্ষেপ ॥ অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের নির্বাচনে শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে তৈরি হয় দুটি সাংবাদিক সংগঠন। অভ্যুত্থান হয় প্রেসক্লাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোট কর্মীরা হঠাৎই প্রেসক্লাবে রাতের অন্ধকারে তালা দিলে সৃষ্টি হয় নতুন বিতর্ক। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস এক মাসের বেশি গ্রীষ্মের ছুটি ঘোষণা করে। আর এ ছুটির মধ্যে ১৭ মে উপাচার্য পদত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন নতুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন ২০ মে।
উপাচার্য নির্বাচন ॥ দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি ১৯৭৩ সালের এ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী তিনি সিনেট পুনর্গঠন করে ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ দেন। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার শিক্ষকদের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয় ক্যাম্পাস। প্যানেল নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন হিসাব-নিকাশ কষেন। শিক্ষকদের এক অংশ যে কোন মূল্যে নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা দেন। সেই লক্ষ্যে অবরোধ কর্মসূচী চলে ক্যাম্পাসে। অন্যদিকে নির্বাচন চান, এমন শিক্ষকরা পাল্টা কমসূচী দিলে তৈরি হয় নতুন মেরুকরণ। সময় গড়িয়ে সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনায় অনুষ্ঠিত হয় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। এতে ৩৮ ভোটে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী উপাচার্য হিসেবে ৪ বছরের জন্য নিয়োগ পান। অবশ্য নির্বাচনে পদত্যাগী শরীফ এনামুল কবির সর্বাধিক পঞ্চাশোর্ধ ভোট পান।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ॥ গত বছরের আগস্টে এক ছাত্রলীগকর্মীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় ক্যাম্পাসে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি। এ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে গেলে ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ ছাত্র আহত হন। মধ্যরাতে চলা সংঘর্ষ গড়ায় দিন পর্যন্ত। টানা ১৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। বাড়ে যাত্রীদের দুর্ভোগ। পরে প্রশাসন ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি সাধারণ ডায়েরি ও পুলিশকে আহত করার ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় কয়েক শ’ শিক্ষার্থীর নামে মামলা হয়। যদিও এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।
অস্থিরতার কারণ অনুসন্ধান ॥ বছর শেষে অস্থিরতার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি। শিক্ষকদের মাঝে সরকারী দল ও বিরোধী দল এবং সরকারী দলের মধ্যে আবার ভিসিপন্থী ও ভিসিবিরোধী দুটি বলয়ের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গ্রুপ এবং উপ-গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের আমি কেন পরামর্শ দিব। তাঁরা বরং আমাদের পরামর্শ দেবেন।
এ নিয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আইনগত সমস্যা রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আইনগতভাবে ইউজিসির হস্তক্ষেপের সুযোগ খুব কম। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটগুলো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দূর করার তাগিদ দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.