মূল্যস্ফীতি উস্কে দেবে? ॥ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি- ০ বিদ্যুতের সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধিতে ফের অস্থির হতে পারে অর্থনীতি ০ সরকারের শেষ বছরে রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে- পারে ॥ অভিমত বিশেষজ্ঞদের by রশিদ মামুন

গত সেপ্টেম্বরে বেড়েছে বিদ্যুতের মূল্য। তিন মাস পেরোতে না পেরোতেই ফের বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির উৎকণ্ঠার মধ্যেই জ্বালানি তেলের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বোরোর সেচ মৌসুম শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়াবে। বাড়বে পরিবহন ভাড়া। একইসঙ্গে শিল্প উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবে। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে জ্বালানির দাম ১০ ভাগ বৃদ্ধি পেলে তাদের পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে হবে। বোরোর মৌসুমে সঙ্কট সামাল দিতে হলে ডিজেলভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুত কেন্দ্র ফুল লোডে চালাতে হবে। ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে সাত টাকা বৃদ্ধি করায় জ্বালানির মূল্য আগের তুলনায় ১১ দশমিক ৪৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি না করলে বিদ্যুত খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়বে। অর্থাৎ জ্বালানি ভর্তুকি বিদ্যুতে যোগ হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, নবেম্বরে (মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাত দশমিক ৪১। গত বছরের শুরুর দিকে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে থাকলেও শেষের দিকে এসে তা এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল থাকা এবং রেকর্ড খাদ্য উৎপাদনের কারণে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মধ্যবিত্ত জনগণ তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে ব্যয় নির্বাহে বাধ্য হবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্নআয়ের মানুষ।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুত প্রকল্পকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, একসঙ্গে জ্বালানি তেলের ব্যবহার দ্বিগুণের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় ভর্তুকি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদনের বাইরে আরও ৩০ লাখ টন পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করতে হবে। দাম বৃদ্ধির আগে লিটারে ডিজেলে ১৬ থেকে ১৮ টাকা লোকসান করছিল বিপিসি। এখন লোকসানের পরিমাণ কমে লিটারে ১০ টাকার মধ্যে চলে আসবে।
বিপিসি চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ব্যবহৃত হয় ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ। অন্য জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ হলেও তা দিয়ে ডিজেলের লোকসান সামাল দেয়া যায় না। মূসক-ভ্যাট তুলে দিলে বিপিসির লোকসান থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
বিপিসি সূত্র বলছে, জ্বালানি তেলের ওপর থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) তুলে নিলে জ্বালানি খাতে সরকারের তরফ থেকে যে ভর্তুকির কথা বলা হচ্ছে তা আর থাকত না। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ২০১১-এর ২৯ ডিসেম্বরের গেজেটে দেখা যায় ডিজেল, কেরোসিনে ও ফার্নেস অয়েলে যথাক্রমে ৭.৫৩ টাকা, ৭.৬২ টাকা এবং ৭.৬২ টাকা মূসক দিতে হয়। এছাড়া ডিলার এবং বিতরণকারী কোম্পানিকে আলাদাভাবে কমিশন দিতে হয়। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধিতে মূসকের পরিমাণ আরও বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর ২৯ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) চাপে করা হয়েছে। গত বছর দাম বৃদ্ধির আগে আইএমএফ সরকারকে জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে চাপ দেয়। এবারও আইএমএফ তাদের ঋণের কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তপূরণের বিষয়গুলো যাচাই করতে এসে তেলের দাম বৃদ্ধি করতে চাপ দেয়। ফলে সরকার তেলের দাম বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে।
তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, যতদূর মনে পড়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন শীতের সময় জ্বালানির চাহিদা কম থাকে। এখন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হবে না। কিন্তু সরকারের এই কাজের সঙ্গে মন্ত্রীর বক্তব্যর কোন সঙ্গতি নেই। এর ওপর এখন বোরো মৌসুম শুরু হচ্ছে। মৌসুমের শুরুতেই দাম বৃদ্ধি করায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। কৃষক এরই মধ্যে অভিযোগ করেছে বোরো চাষে তাদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। কাজেই বোরো উৎপাদনে তারা আগ্রহ হারাচ্ছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি তাদের কাছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো কাজ করবে। এতে বিদ্যুত কেন্দ্রে সরকারকে ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হবে। ফলে এক খাতের ভর্তুকি আরেক খাতে যাবে। এছাড়া তেলের দাম পাঁচ ভাগ বাড়লে পরিবহন ভাড়া ১৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধির নজির রয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখৎ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের শেষ বছরে নানা রকম ব্যয় থাকে। তাই বাজেটের ওপর চাপ কমাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া আইএমএফের একটি চাপ তো ছিলই। যে ধরনের ভর্তুকি কমালে মূল্যস্ফীতি আরও উস্কে দেয়া হবে তা করা থেকে বিরত থাকা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, তা না হলে উৎপাদন এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। আমরা সার্বিকভাবে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছি জানিয়ে তিনি বলেন, এতে স্ফীতি আরও বাড়বে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ছয় দফায় জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করে। এর মধ্যে একবার কমানো হয়েছে আর পাঁচবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি ডিজেলের দাম লিটারে দুই টাকা কমিয়ে ৪৬ টাকা থেকে ৪৪ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। দুই মাসের মাথায় ১ মার্চ ফার্নেস অয়েলের দাম ৩০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সরকারের বিপুল পরিমাণ লোকসান কমাতে গত বছর চার দফা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে ৬ মে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেলের দাম দুই টাকা করে বৃদ্ধি করা হয়। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর এবং ১০ নবেম্বর সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম দুই দফায় ১০ টাকা করে বৃদ্ধি করা হয়। বছরের শেষ দিকে এসে আইএমএফের চাপে ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম আবারও ৫ টাকা করে বৃদ্ধি করা হয়। আর শুক্রবার থেকে ডিজেল, কেরোসিনে ৭ টাকা এবং পেট্রোল এবং অকটেনের দাম ৫ টাকা করে বৃদ্ধি করা হয়। তবে ফার্নেস অয়েলের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.