বিশ্বে মোট শিক্ষার্থীর গড় ছাত্রী সংখ্যায় বাংলাদেশ ওপরে- ঝরে পড়ার হার কমলেও প্রাথমিকে এখনও উদ্বেগজনক

মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সবার ওপরে। কেবল এই দেশগুলোতেই নয়, বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ গড়ে যেখানে ৪৮ শতাংশ সেখানে বাংলদেশে মোট শিক্ষার্থীর ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫২ শতাংশই ছাত্রী।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ শিক্ষা পরিসংখ্যান রিপোর্টে দেশের শিক্ষার এই চিত্র উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ক্রমেই কমছে। প্রাথমিকে হার কমলেও এই সংখ্যা এখনও আছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে। ২০০৫ সালে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার যেখানে ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি, সেখানে এই মুহূর্তে ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশে।
দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগ্রহণ এবং শিক্ষার ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে ব্যানবেইস পরিচালক আহসান আবদুল্লাহ বলেছেন, দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক লাখ ১৪ হাজার ১১৪টি। যদিও এ ছাড়া সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় বেশ কিছু কওমী মাদ্রাসা দেশে প্রতিষ্ঠিত আছে। সারাদেশে এক লাখ ১৪ হাজার ১১৪ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে তিন কোটি ছয় লাখ ৩৭ হাজার ৪৯১ শিক্ষার্থী। যা বিশ্বের বহু দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ছে, কমছে ঝরে পড়ার হার। তবে ঝরে পড়ার এই হার এখনও ‘উদ্বেগজনক’। শিক্ষার সার্বিক চিত্রকে আশাব্যঞ্জক অভিহিত করে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যাবে আমরা ক্রমেই ইতোবাচক অবস্থানে যাচ্ছি। আগানোর মাত্রা কম তবু তা আশার জাগার মতো। রিপোর্টে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি তথ্যবহুল চিত্র বেরিয়ে এসেছে। বলা হয়েছে, ছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। মাধ্যমিক স্তরে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৪৮ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫২ শতাংশই ছাত্রী। মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের অংশগ্রহণে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পর অবস্থান ভুটানের। এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী হচ্ছে ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া মালদ্বীপ ও ইরান ৪৭, ভারত ৪৫, নেপাল ৪৩ এবং আফগানিস্তানে ছাত্রীর অংশগ্রহণ ৩১ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে নারীদের শিক্ষার চিত্র সম্পর্কে ব্যানবেইস পরিচালক বলেছেন, বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু আমরা এ দুটি দেশের এই চিত্রটি সংগ্রহ করতে পারিনি। দেশের শিক্ষকদের পরিসংখ্যান সম্পর্কে এবারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত আছেন আট লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৪ জন শিক্ষক। মহিলা শিক্ষক আছেন দুই লাখ ৮৮ হাজার ৪৬২ জন। শতকরা হার ৩৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। তিন কোটি ছয় লাখ ৩৭ হাজার ৪৯১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা এক কোটি ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৯ জন। কারিগরি শিক্ষাগ্রহণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হতাশাজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে রিপোর্টে। দেখা গেছে, তিন কোটি ছয় লাখ ৩৭ হাজার ৪৯১ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র পাঁচ লাখ ছয় হাজার ৫৫৬ জন টেকলিক্যাল এ্যান্ড ভোকেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে। ব্যানবেইস পরিচালক বলেন, ২০১১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ ভর্তি হয়। এর মধ্যে ৯২ দশমিক ২১ শতাংশ ছাত্র এবং ৯৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছাত্রী। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৯ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। এর মধ্যে ৪০ দশমিক ৩০ শতাংশ ছাত্র এবং ৩৯ দশমিক ৩০ শতাংশ ছাত্রী।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষর্থীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২০ শতাংশ পড়াশোনা শেষ করছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। ২০১১ সালে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তিযোগ্য জনসংখ্যার ৫৬ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও তাদের মধ্য থেকে ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। এর মধ্যে ৪৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ ছাত্র এবং ৫৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছাত্রী। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরে ২০০৫ সালে ৮০ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ, ২০০৬ সালে ৭৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৬১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৫৫ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৫৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ ২০১১ সালে ঝরে পড়ার হার হয়েছে ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০০৫ সালে ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার ছিল ৭৬ দশমিক ৫৪ এবং ছাত্রীদের ছিল ৮৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। সর্বশেষ ছাত্রদের হার ৪৬ দশমিক ৭৩ এবং ছাত্রীরা ঝরে পড়ছে ৫৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কমলেও তা এখনও হতাশাজনক। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে ২০১১ সালে ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও এদের মধ্য থেকে ৭৪ দশমিক ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। এর মধ্যে ৭৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছাত্র এবং ৭৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ ছাত্রী। যদিও এই সময় অনেকে পড়ালেখা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে এবং অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে শিক্ষা থেকে বাইরে চলে যায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এবারের বার্ষিক এই রিপোর্ট আরও বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৩ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৪ শিক্ষার্থীর বিপরীতে আছেন একজন শিক্ষক। অন্যদিকে কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ৩০, মাদ্রাসায় ১ : ২১, প্রফেশনাল ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ১ : ১৫, টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানে ১ : ২২ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.