গণপরিবহন-সিদ্ধান্তের আগেই শুরু যাত্রীদের পকেটকাটা by পার্থ সারথি দাস

সাজিদা বেগম দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকা থেকে রায়পুর যাবেন। সায়েদাবাদ টার্মিনালের একটি কাউন্টারে ঢুকেছেন টিকিট কিনতে। কাউন্টারে দাঁড়াতেই তাঁর কাছে বাড়তি ৫০ টাকা চাওয়া হলো। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সাজিদা- 'জানলাম না, শুনলাম না। রাইত পোহাইতেই বললেন ভাড়া বাইড়া গেছে।
বাইড়া গেছে বললেই দিমু নাকি? আগের ভাড়াটাই রাখেন।' ভাড়া কি সত্যি বেড়ে গেছে, জানতে চাইলে ইকোনো সার্ভিসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪৬৭৪১) বাসচালক কামাল মজুমদার উৎসাহের সঙ্গেই উত্তর দিলেন, 'আইজ থাইক্যা ৫০ টাকা ভাড়া বেশি নিতাছি।' একটি কারণ দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন, 'রাস্তার যা অবস্থা, একটু বেশি না নিলে পোষায় না।'
বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। তবে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত হয়নি। তবু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক গণপরিবহনেই গতকাল বিভিন্ন অজুহাতে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়।
রাজধানীতে শতকরা ৮০ ভাগ গণপরিবহনই রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস-সিএনজিতে চলে বলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা যায়। তবে গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে গ্যাসে চালানো গণপরিবহনেও বাড়তি ভাড়া নিতে দেখা গেছে। পরিবহন মালিকদের বিভিন্ন পক্ষ চলতি সপ্তাহেই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি করছে বলেও জানা গেছে।
এদিকে ভাড়া পুনর্নির্ধারণের জন্য গঠিত ১২ সদস্যের কমিটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে জ্বালানি তেলের ভাড়া বাড়লে দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাসে কি হারে ভাড়া বাড়ানো সম্ভব তার একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে। বর্তমানে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া এক টাকা ৩৫ পয়সা। কমিটির একটি সূত্র জানিয়েছে, খসড়া প্রস্তাবে তা এখন কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৫৬ পয়সা করার একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি হয়ে আছে। এই প্রস্তাবটি গোপন রাখা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আগামী কোনো বৈঠকে এই বাড়তি ভাড়ার হার চূড়ান্ত হবে।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাসে ভাড়ার খসড়া প্রস্তাব তৈরি হলেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর গণপরিবহনের বাড়তি ভাড়ার ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কোনো আগ্রহ নেই। কারণ দাম বেড়েছে জ্বালানি তেলের। আর রাজধানী ও চট্টগ্রাম নগরীতে শতকরা ৮০ ভাগ গণপরিবহনই গ্যাসচালিত। এখন মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি বাস ও মিনিবাস জ্বালানি তেলে চলছে। রেশনিং পদ্ধতিতে গ্যাস দেওয়ায় ও গ্যাসের দাম বাড়ায় এখন অনেকে জ্বালানি তেলেই গাড়ি চালাচ্ছেন যুক্তি দেখিয়ে মালিকদের বিভিন্ন পক্ষ দূরপাল্লা ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর গণপরিবহনে ভাড়া বাড়াতে চাইছে।
ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির প্রধান বিআরটিএর চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, '১০-১২ দিন আগে পাঁচজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী কমিটি দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে বাড়তি ভাড়ার একটি খসড়া তৈরি করেছে। সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়।'
বাড়তি ভাড়া আদায়ের সরকারি সিদ্ধান্ত না হলেও গতকাল রাজধানীতে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে বাস, অটোরিকশা ও ট্যাক্সি ক্যাবে। গতকাল দুপুরে সায়েদাবাদে এশিয়া ক্লাসিক পরিবহনের কাউন্টারে গেলে দেখা যায়, ঢাকা থেকে মাইজদী হয়ে সোনাপুর রুটে এই বাসে ভাড়া ৬০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই এই বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল। নিজের শ্যালকের বিয়েতে যাওয়ার জন্য কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মো. হান্নান। কালের কণ্ঠকে বলেন, '৬০ টাকা বাড়াই দিছে। আগে যে বাসগুলা দিয়া যাতাম হেইগুলার কয়েকডা বাস বন্ধ হইগেছে। যামু কি না ভাবতছি।'
বিষয়টি স্বীকার করে কাউন্টারে কর্তব্যরত ব্যবস্থাপক মো. নাসির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গাড়ি আসা-যাওয়ায় আগে লাগত ৪ ঘণ্টা। এখন লাগছে আট ঘণ্টা। তাই আজ (গতকাল) থেকে বেশি ভাড়া নিচ্ছি বাধ্য হয়েছে। যানজটে ট্রিপ কমে গেছে।'
গতকাল রাজধানীর রাজারবাগ এলাকায় গ্রীন লাইন পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীদের অনেকেই বাড়তি ভাড়া আদায় হবে কি না এ নিয়ে শংকিত। চট্টগ্রামের দুটি টিকিট কিনতে আসা রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আজ আগের ভাড়াই নিছে। কাল হয়তো বাড়াই দেব।' গ্রীন লাইনের কর্তব্যরত সেলস ম্যানেজার মহসীন কবীর বলেন, 'আমাদের গাড়িগুলো চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। এগুলো চলে জ্বালানি তেলে। তাই ভাড়া বাড়াতেই হবে।'
কমলাপুর এলাকায় নিজের ট্যাক্সি ক্যাবের (ঢাকা মেট্রো-প ১১৪৪৩৬) সামনে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. অহিদ। তেলের দাম বাড়ায় ভাড়া বাড়াবেন ইচ্ছামতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তেলের দাম বাড়লে আমাদের কি? দোষ তো সরকারের। আমরা তো যাত্রীর কাছ থেকেই বেশি নেবই।' দেখা গেল, তার ক্যাবের রুট পারমিটের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। গাড়িটিও লক্কর-ঝক্কর, ক্যাবের ভেতর ভাড়া নির্ধারণের মিটারও নেই। গ্যাসে চললেও ক্যাবটি মাঝেমধ্যে তেলে চালাতে হয় দাবি করে অহিদ বলেন, বাধ্য হয়ে আগের চেয়ে বেশি ভাড়া নিতে হবে তাকে। ট্যাক্সি ক্যাবের জন্য পাশে অপেক্ষারত যাত্রী এনামুল কবীর বলেন, কমলাপুর থেকে মতিঝিল উত্তরা যেতে ৫০০ টাকার নিচে ক্যাব মিলছে না। আগে গেছি ৩০০ টাকায়।
রাজধানীতে অটোরিকশাগুলো চলছে গ্যাসে। পান্থপথ মোড়ে অপেক্ষারত চালক (গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো থ-১৪৩৩৯৬) আল আমিন বলেন, 'দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিন ট্রিপ দিছি। ভাড়া পাইছি ১৬০ টাকা। রামপুরা থেকে নিউমার্কেট গিয়ে মিটারে উঠেছে ৬৫ টাকা। নিছি ৭০ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে গুলিস্তান থেকে পান্থপথ পর্যন্ত মিটারে উঠেছে ৭০ টাকা: নিছি ৯০ টাকা।' মালিকদের দিনে ৬৫০ টাকা জমা দিতে হয় জানিয়ে তিনি বললেন, 'বেশি না নিলে পোষায় না।' মালিবাগ রেলগেটে ফাল্গুন পরিবহনের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মন্টু সরকার। মন্টু জানান, 'মালিবাগ রেলগেট থেকে উত্তরা যাওয়ার ভাড়া ২৭ টাকা। গতকাল রাখা হয়েছে ৩০ টাকা।'
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব কে এনায়েত উল্ল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি কয়েকদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। এখন গণপরিবহনের ভাড়া বাড়াতে হবে। আমরা গত ২৯ ডিসেম্বর ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমাদের দাবি হলো দূরপাল্লার শুধু নয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়াতে হবে। কারণ দুটি মহানগরীতে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি বাস ও মিনিবাস জ্বালানি তেলে চলে। আমরা এ সপ্তাহের মধ্যেই বাড়তি ভাড়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে আশা করছি।'
এদিকে আমাদের খুলনা প্রতিনিধি কৌশিক দে জানিয়েছেন, গতকাল আচমকা খুলনা-কুষ্টিয়া রুটের বাসভাড়া ২২০ থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা হয়েছে। খুলনা-যশোর রুটে ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা, খুলনা-বেনাপোল ১৩০ টাকা থেকে ১৪০, খুলনা-মেহেরপুর ২২০ থেকে ২৩০, খুলনা-চুয়াডাঙ্গা ২০০ টাকা থেকে ২১০, খুলনা-গোপালগঞ্জ ১০০ টাকা থেকে ১১০, খুলনা-বরিশাল ১৭০ টাকা থেকে ১৯০, খুলনা- টেকেরহাট ১৫০ টাকা ১৬০, খুলনা-বাগেরহাট ৬০ টাকা ৬৫, খুলনা-পিরোজপুর ৯০ থেকে ১০০ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.