রাঙ্গামাটিতে রাজপুণ্যাহ সেই কবে হয়েছে

পাহাড়ের রাজপুণ্যা হলো পাহাড়ের মানুষের একটি ঐতিহাসিক উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ অনাদিকাল থেকে এই উৎসব পালন করে আসছে। চাকমা রাজা রাঙ্গামাটিতে, বোমাং রাজা বান্দরবানে ও মং রাজা খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে এই উৎসব পালন করে থাকে।
প্রজাদের নিকট থেকে জুমের খাজনা আদায় করার জন্য প্রতিবছর এই উৎসব পালন করে। বিশেষ করে জমির ধান ওঠার পর এই উৎসবের আয়োজন করে। এই উৎসবে প্রতিটা রাজা বা সার্কেল চীফের অধীনে যত হেডম্যান ও কারবারি রয়েছে, তাঁরা রাজার নিকট উপঢৌকন নিয়ে রাজাকে খাজনা দিতে আসেন। এই সময়ে রাজবাড়িতে খাজনা আদায় করার জন্য রাজাদের ঐতিহ্য অনুসারে বিশেষ রাজদরবার বসে। সেই সময়ে রাজা রাজ মুকুট পরে আসনে বসেন। তাদের প্রথা অনুসারে প্রতিটা মৌজাপ্রধান হেডম্যান ও পাড়াপ্রধান কারবারি একটি তরবারি হাতে নিয়ে রাজার নিকট গিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে তাদের প্রত্যেক এলাকার খাজনা আদায় করে থাকে। এই খাজনার শতকরা ৪২ অংশ পেয়ে থাকে রাজা, ৩৭ শতাংশ পেয়ে থাকে হেডম্যান ও ২১ শতাংশ সরকার পেয়ে থাকে।
পুণ্যার সময় রাজবাড়িতে বিশাল মেলা বসে। এই মেলায় পাহাড়ীদের নানা পণ্য দ্রব্য যেমন স্থান পায় তেমনি পাশাপাশি সমতল এলাকা থেকে বিভিন্ন পণ্য দ্রব্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা মেলায় পসরা সাজিয়ে বসে। এই সঙ্গে মেলায় চলে সঙ্গীতানুষ্ঠান, যাত্রাগান, পালাগান ও পাহাড়ীদের নানা বিচিত্রানুষ্ঠান। এই যেন পাহাড়ী-বাঙালীর মিলনমেলা। এক সময়ে পাহাড়ী মানুষের একমাত্র উৎসব ছিলা এই রাজ পূন্যা। সারা পাহাড়ের মানুষ এই উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহ থাকে। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে চাকমা রাজার রাজপুণ্যা ছিল এককালে দেখার মতো একটি উৎসব। কর্ণফুলী নদীর তীরে এই পুণ্যা হতো অত্যন্ত আর্কষণীয় ভাবে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে এই রাজবাড়িসহ পাহাড়ী-বাঙালীর বিশাল জনপদ তথা রঙ্গামাটি শহর পানির তলে থলিয়ে যায়। এর পর থেকে রাঙ্গামাটির রাজপুণ্যা হয়নি। তৎকালীন রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৬৩ সালে একবার রাজপুণ্যা করেছিল। তা তেমন জমেনি যার ফলে তৎকালীন রাজা ত্রিদিব রায় আর রাজপুণ্য করেনি। এর পর দীর্ঘ দিন ধরে আর রাজপুণ্যা হয়নি। ১৯৭৭ সালের ২৫ নবেম্বর বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায়কে রাজাপুত্র ঘোষণা করার জন্য ত্রিদিব রায় আর একবার বর্তমান রাজবাড়িতে রাজপুণ্যা করেছিলেন। এর পর ১৯৭৮ সাল থেকে আবার রাজপুণ্যা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে রাজা দেবাশীষ রায় তার পুত্র আর্যদেবকে রাজা পুত্র ঘোষণা করার জন্য একবার রাজপুণ্যা করেছিল। সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায় রাঙ্গামাটিতে রাজপুণ্যা করেছিল। এর পর ১০ ডিসেম্বর ২০১০ সালে চাকমা রাজবাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর রাঙ্গামাটিতে আর রাজপুণ্যা হয়নি। রাঙ্গামাটিতে রাজপুণ্যা না হওয়ায় এখানে পাহাড়ী-বাঙালীর মিলনমেলায় যে আনন্দ হতো তা থেকে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই এলাকার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখা ও ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব ধরে রাখার জন্য এখানে সরকারীভাবে রাজপুণ্যা হওয়া একা প্রয়োজন কলে এলাকার প্রবীণরা মনে করেন। Ñমোহাম্মদ আলী, রাঙ্গামাটি

No comments

Powered by Blogger.