এবার রাজধানীতে ধর্ষণের পর খুন- ঢাকাই হলো কাল ‘নিরুপমা’র by আশরাফুল ইসলাম

দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার নাগরি-সাগরি গ্রামে দাদীর কাছে নিরাপদেই ছিলো ১০ বছরের মেয়ে ‘নিরুপমা’(ছদ্মনাম)। কিছুটা রাগী আর মাথায় এলোথেলো চুলের ‘নিরুপমা’র নিরাপদ ঠাঁই একমাত্র দাদীর কাছেই হতে পারে।
দুরন্তপনা আর হাজারো আদর-আবদার দাদী ছাড়া আর কার কাছেই বা করবে সে।

কোন কুক্ষণেই না সাধ চেপেছিলো তার রঙ্গিন শহর ঢাকা দেখার। তবে আলোঝিলমিল এ শহরেও যে এতো অন্ধকার, তা জানা ছিলো না এ অবুঝ মেয়েটির।

শনিবার দুপুরে আচমকা এক ঝড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় তাকে। নির্মম-নির্দয় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নিভে যায় কোমলপ্রাণ মেয়েটির জীবন প্রদ্বীপ।

নাগরি-সাগরি গ্রামের বাসিন্দা পরিবহন শ্রমিক বাবুল কিছুটা স্বাদ করেই রঙ্গিন শহর দেখাতে দাদীর নিরাপদ আশ্রয় থেকে গত ১০ থেকে  ১২ দিন আগে ‘নিরুপমা’কে ঢাকায় নিয়ে আসেন। রাজধানীর মিরপুর এলাকার শাহ আলী থানাধীন কমার্স কলেজ সংলগ্ন হাজীরোড ঝিলপাড় বস্তির ভাড়া বাসায় মেয়ে নিয়ে উঠে বাবুল।

চলতি মাসের শুরুতে এ বাসা ছেড়ে পাশের গোদারাঘাট (খেয়াঘাট) এলাকায় বাসা ভাড়া নেন তিনি। ঢাকাতে এসেও গ্রামের চঞ্চলার চঞ্চল প্রাণ এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকতে নারাজ। বাসা ছেড়ে দিলেও ‘নিরুপমা’ প্রতিদিনই চলে আসতো আগের বাসার পাশের রুমে সমবয়সি শিশুর সঙ্গে খেলতে।

অনেকটা বাধ্য হয়েই মা নার্গিস বেগম ‘নিরুপমা’কে কিছুটা শাসনে রাখার চেষ্টা করছিলেন।

শনিবার দুপুরেও তেমনি মা’য়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ভাতের প্লেট ছুড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে। খেলার সাথী ঝিলপাড়ের বস্তির খোকনের মেয়ে খালেদার খোঁজে বিকেলে সে চলে আসে ওই বস্তিতে।

বিকেল ৪টার দিকে ওই বস্তির সিএনজি চালক খোকনের রুমের বাঁশের আড়ায় ‘নিরুপমা’র গলায় ওড়না পেচানো মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখে ভূত বলে চিৎকার করে উঠে খেলার সাথী খালেদা। তবে এ সময় খোকন বাড়িতেই ছিলেন।

শনিবার রাত দেড়টার দিকে ওই বস্তিতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

খবর পেয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করে শাহ আলী থানা পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে।

ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ আর শোকে পাথর হতভাগ্য ‘নিরুপমা’র বাবা-মা। 

ঝুলন্ত ‘নিরুপমা’র মৃতদেহ উদ্ধারের পর পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে লাশ ঝুঁলিয়ে রাখা হয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বস্তির এক নারী বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আমি ঝুলন্ত অবস্থায় মাইয়াডারে দেখছি। মাইয়াডারে অনেক নির্যাতন কইরাই মাইরা ঝুঁলাইয়া রাখছে গো ভাই-মাইয়াডা ফাঁস লয় নাই।’’

এ সময় সমবেত বস্তিবাসী একাধিক নারী বাংলানিউজকে জানান, মেয়েটিকে কে বা কারা ধর্ষণ করেছে তা কেউ দেখেনি । তবে যার ঘর থেকে মেয়েটির লাশ উদ্ধার হয়েছে, সেই সিএনজি চালক খোকনের চরিত্র ভালো না। এ পর্যন্ত খোকন তিনটি বিয়ে করলেও দুই স্ত্রীকেই ছেড়ে দিয়েছে সে।

তারা আরও জানান, ভোলা জেলার বাসিন্দা সিএনজি চালক খোকন অনেক দিন থেকেই এ এলাকায় বাস করে আসছেন। আগের প্রতিবন্ধী স্ত্রীর দুই সন্তান নিয়ে পরে বিয়ে করা স্ত্রীর সঙ্গে ঝিলপাড়ের বস্তিতে ভাড়া থাকছে সে। ঘটনার পর থেকে পলাতক খোকন।

এ ঘটনায় ‘নিরুপমা’র মা নার্গিস বেগম বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯(৩) ধারা (ধর্ষণের পর হত্যা) মামলা দায়ের করেছেন।

মামলায় খোকনসহ ৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও কয়েকজনকে অজ্ঞতানামা আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে রুমে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ঘটনার পর পুলিশ ‘নিরুপমা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই বস্তি থেকে দুই নারীকে আটক করে নিয়ে গেছে স্থানীয়রা এমন দাবি করলেও শনিবার ভোররাত পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেনি শাহ আলী থানা পুলিশ।

শাহ আলী থানা পুলিশের ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) ইদ্রিস আলী এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এখনও কাউকে গ্রেফতার দেখানো হয়নি।’’

উল্লেখ্য, বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী দেশে ২০১২ সালে ধর্ষিত হয়েছেন ৭৭১ জন। যাদের ১৫৭ জনই গণধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১০৬ জনকে।

গত কয়েক দিনের ব্যবধানে ভারতের দিল্লিতে ও বাংলাদেশের ফরিদপুরে, টাঙ্গাইলের মধুপুরের গণধর্ষণসহ বিভিন্নস্থানে ধর্ষণের ঘটনায় দেশে বিদেশে যখন প্রতিবাদে সোচ্চার তখন আবারও ধর্ষণের পর শিশু হত্যার ঘটনা ঘটলো।

No comments

Powered by Blogger.