সরেজমিন ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন- ‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণঃ নেপথ্যে অভিনয়ের প্রলোভন!

(গণ-ধর্ষণের ঘটনার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম এখন টাঙ্গাইলে। এই টিমে আছেন বিশেষ প্রতিনিধি ও চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমীর।
তাদের সঙ্গে আছেন টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি সুমন রায় ও মধুপুর প্রতিনিধি এসএম শহীদ।)
মধুপুর, টাঙ্গাইল থেকে: নাটকে অভিনয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মধুপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেওয়া হয় ‘অপরাজিতা’কে (‘অপরাজিতা’ নির্যাতিত মেয়েটির আসল নাম নয়। বাংলানিউজ এখন থেকে আসল নামের পরিবর্তে মেয়েটির এই ছদ্মনামটি ব্যবহার করবে।)।
 
এদিকে, রিমান্ডে থাকা আসামিদের সবাই গণধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

শুক্রবার দিনভর চার ধর্ষক, ধর্ষণে সহায়তাকারী বান্ধবী বীথি আক্তার ওরফে ইভা ও ‘অপরাজিতা’---সবার বাড়ি সরেজমিনে ঘুরে এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এমন আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

মধুপুর থানায় দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামি বীথি (২০), দুই নম্বর এসএম নুরুজ্জামান ওরফে গেদা (৪৩), তিন নম্বর আসামি হারুনুর রশিদ (২৭), চার নম্বর শাহজাহান আলী (৪০), পাঁচ নম্বর আসামি মনিরুজ্জমান মনি (৩৯)।
এদের মধ্যে বীথি পাঁচ বছর আগে ঢাকার পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। বিয়েও হয় ঢাকায়। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় দেশের বাড়ি চলে আসেন ২০০৭ সালের দিকে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বীথি টাঙ্গাইল সদরে শাপলা নার্সিং হোমে চাকরি শুরু করেন। একসময় এ কাজ ছেড়ে সেলাইয়ের কাজ শেখেন, কিছুদিন বাসাবাড়িতে পরিচারিকার কাজও করেন। সর্বশেষ মাস ছয়েক আগে নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। বীথি অভিনীত একটি নাটকের ভিসিডি বাংলানিউজের হাতে এসে পৌঁছেছে। এতে তিনি মূল নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রায় ১৫ বছর আগে বীথির বাবা তার মাকে তালাক দেন। মা পাঁচ বছর বয়সী বীথিকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। সেবছরই বিয়ে করে বীথিকে ছেড়ে চলে যান মা। বাবাও আরেকটি বিয়ে করেন। বীথি বড় হয়ে ওঠেন নানার বাড়িতে। বাবা-মার সাহচর্যবঞ্চিত শিশুকাল থেকেই। নানাবাড়িতে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে কিশোরী বীথি এক সময় ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নেন।

পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে আরো একটি নাটকের কাজ চলছিল। ‘নিয়তি’ নামের এ নাটকটিতে অভিনয় করছিল ‘অপরাজিতা’। একই নাটকে শিক্ষকের চরিত্রে ছিলেন আসামি গেদা। মূল নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করা ‘ভাদাইমার হাতে চেংগু খুন’ নাটকটি স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়।

নাটকটি ‘মধুপুর চ্যানেলে’ নিয়মিত দেখানো হয়। স্থানীয়দের মধ্যে এটি ‘ডেঙ্গু চ্যানেল’ নামে পরিচিত, ঠাট্টা করেই এ নাম দিয়েছে তারা। এ চ্যানেলকে ঘিরে বড়সড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই সিন্ডিকেট নাটক নির্মাণ করে, বিয়ের অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা ইত্যাদি ভিডিও করে এবং কেবল অপারেটররা তা সম্প্রচার করে। মধুপুর চ্যানেলটি পরিচালনা করে কেবল অপারেটর বাবুল ভিডিও। প্রতিষ্ঠানটি মালিক বাবুল রানা।

নাটক, মিউজিক ভিডিও ইত্যাদি অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হয় মধুপুর সদরের সুপ্তি কম্পিউটার থেকে। এখনো দোকানটির সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, “এখানে ভিডিও ক্যামেরা ভাড়া পাওয়া যায়।” সুপ্তি কম্পিউটারের মালিক মনিরুজ্জামান মনি। তার কর্মচারী হারুনুর রশিদ দোকানটি পরিচালনা করতেন।Tangail

মধুপুর থানা পুলিশের ধারণা, মনিরুজ্জামান মনি ওই সিন্ডিকেটের হোতা। মনি  মধুপুর উপজেলা যুবদলের তিন নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক। বিগত বিএনপির সরকারের আমলে তিনি ঠিকাদারি করতেন। অভিযোগ রয়েছে, মিউজিক ভিডিও, নাটক ইত্যাদি নির্মাণে অর্থেরও যোগান দেন মনি।

এর সঙ্গে বড় চক্র রয়েছে। চক্রের শেকড় ঢাকাসহ সারা দেশে বিস্তৃত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় লোকজন বলেন, “গেদা নাটকে অভিনয় করছিলেন বলে শুনেছিলাম।” নাটকটি মাছরাঙা টেলিভিশনে সম্প্রচার হবে বলেও কলাকুশলিরা প্রচার করে।

গেদার দোকানের পাশে ছিট কাপড়ের ব্যবসা করেন আলী আকবর। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “গেদা সবাইকে বলতেন, আমি নাটকে অভিনয় করছি। খুব শিগগিরই এটি মাছরাঙা টিভিতে দেখানো হবে।” আলী আকবরের দোকানে যাতায়াত ছিল পুলিশের রিমান্ডে থাকা আসামিদের। এমনকি তিনি বীথিকে যেতে-আসতে দেখেছেন বলে জানান।

মধুপুরের অদূরে ইদিলপুর বাজারে গেদার মোবাইলফোন রিচার্জের দোকান। দোকানে মোবাইল সার্ভিসের কাজও করা হতো। গেদু ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ছিলেন। তার দুই জমজ মেয়ে (১০)। তার বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

মামলার এজাহারে থাকা তিন নম্বর আসামি হারুন মধুপুর বাজারের সুপ্তি কম্পিউটার্সের কর্মচারী। এখানে তিনি ভিডিও ক্যামেরা ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি দলিল বিক্রি ও লেখার কাজও করতেন।
জানা গেছে, এখান থেকে ধারণ করা ভিডিওচিত্র স্থানীয় মধুপুর চ্যানেলে সম্প্রচার করা হতো। হারুনের দুই ছেলে।
 Tangail
চার নম্বর আসামি শাহজাহান আলীর (৪০) বাড়ি মধুপুর পৌরসভার সীমানার বাইরে। তার তিন ছেলেমেয়ে।

অপরাজিতার (১৫) পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৬ ডিসেম্বর বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলে সকাল ১১টার দিকে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান বীথি। এরপর ১০ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে রসুলপুর রেলক্রসিংয়ের পাশে অপরাজিতাকে অর্ধচেতন অবস্থায় পায় পরিবার। তার ভাই তাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসে। ১২ ডিসেম্বর মেয়েটিকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে তিনদিন চিকিৎসা নেওয়ার সে মামার বাড়ি যায়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় আবারও তাকে টাঙ্গাইল, সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে এরই মধ্যে ‘অপরাজিতা’ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।

মধুপুর থানার দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান নিজেই। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “ঘটনা সত্যি। শতভাগ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত চলছে। অপরাধীদের কেউ-ই ছাড় পাবে না।”

ওসি বলেন, “তিনদিন রিমান্ড শেষে চার আসামিকে রোববার আদালতে হাজির করা হবে।” এদিকে, একদিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে বান্ধবী বীথিকে।

রিমান্ডে থাকা আসামিদের সবাই গণধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন বলে মধুপুর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
প্রতিবেদকঃ আহমেদ রাজু, রানা রায়হান, সুমন রায়, এসএম শহীদ

(ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম অংশ)

No comments

Powered by Blogger.