সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে তদন্তের আবেদনঃ বিচারক শামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে সম্পাদক মাহমুদুরের ২৯ অভিযোগ

সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (মুদ্রা পাচার), বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন ভঙ্গ ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সম্পদের হিসাব গোপন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের শপথ ও আচরণবিধি ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট ২৯টি অভিযোগ করেছেন দৈনিক আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির কাছে ইংরেজিতে লেখা ১৬ পৃষ্ঠার অভিযোগ তিনি নিজে উপস্থিত হয়ে পেশ করেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মঙ্গলবার সকাল ১১টায় অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেছেন। তারপরই রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগের কপি পেশ করা হয়। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে এসব অভিযোগ তদন্তের আবেদন করেছেন মাহমুদুর রহমান।

সুর্নিদিষ্ট ২৯ অভিযোগঃ
আমার দেশ সম্পাদক তার অভিযোগে বলেছেন, মানিলন্ডারিং (মূদ্রা পাচার) আইন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন ও আয়কর আইন অনুযায়ী বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে লন্ডনের একটি আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলায় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী জবাব দেয়ার জন্য সময়ের আবেদন করেছেন।

মানিলন্ডারিং আইন ভঙ্গের অভিযোগে বলা হয়, বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ২০১০-১১ সালের আয়কর হিসাবে দেখিয়েছেন লন্ডনে তার তিনটি বাড়ি রয়েছে। এই বাড়িগুলো কিনেছেন ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে। তিনটি বাড়ির মধ্যে একটি বাড়ির ঠিকানাও অসম্পূর্ণ বা ভুল দেয়া হয়েছে। আয়কর নথিতে উল্লেখ করা 6 Ruskin Way, London SW17 বাড়িটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আয়কর নথিতে দেখানো হয় তিনি ৫০ লাখ টাকায় এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাড়ি বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে ৪০ লাখ টাকা লন্ডনে তিনটি বাড়ি ক্রয় করতে ব্যয় হয় ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আয়কর নথিতে উল্লেখিত ৩টি বাড়ির বাইরেও লন্ডনে তার অপর একটি বাড়ি রয়েছে। আয়কর নথিতে লন্ডনে তিন বাড়ি ক্রয়ে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন তার কয়েক গুণ বেশি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এই টাকার কোনো হিসাব বা উৎস আয়কর নথিতে দেখানো হয়নি।

বাংলাদেশ থেকে টাকা লন্ডনে কী পন্থায় পাঠানো হয়েছে তার কোনো উল্লেখ আয়কর নথিতে নেই। বৈদেশিক মূদ্রা বিনিময় আইন ও মানিলন্ডারিং (মূদ্রা পাচার) আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের বাইরে এত বিপুল পরিমাণ টাকা সরাসরি পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।

আরো অনুসন্ধানে দেখা যায়, লন্ডনের ভুমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক লন্ডনের 108 Sheppey Road, Dagenham (RM9 4LB) ঠিকানার বাড়িটি কিনেছেন সেখানকার স্থানীয় মুদ্রা এক লাখ ৮৬ হাজার পাউন্ডে। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ২০০৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি এই টাকা পরিশোধ করে সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করেছেন।

লন্ডন ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী 26 The Warrent, London (E12 5HY)  ঠিকানার বাড়িটির মালিক হলেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি এই বাড়িটি কিনেছেন। রেজিস্ট্রি দলীলের তথ্য অনুযায়ী বাড়িটির ক্রয় মূল্য হচ্ছে লন্ডনের স্থানীয় মূদ্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড।

ভুমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী 94 East Hill. London (SW18 2HF) বাড়িটির মালিক হলেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং নাদিয়া চৌধুরী। গত বছরের (২০১১) সালের ২১ নভেমবর বাড়িটি তাদের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়। এর ক্রয় মূল হচ্ছে লন্ডনের স্থানীয় মূদ্রায় ১০ হাজার পাউন্ড। এই বাড়িটির ক্রয় রেজিস্ট্রারে তাদের ঠিকানা দেখানো হয়েছে 108 Sheppey Road, Dagenham (RM9 4LB)| 94 East Hill. London (SW18 2HF এই সম্পত্তিটি আয়কর নথিতে দেখানো নেই।

তার আয়কর নথিতে 6 Ruskin Way, London SW17 ঠিকানায় আরো একটি সম্পত্তি দেখানো হয়েছে। এই ঠিকানাটি ভূল অথবা  অসম্পূর্ণ অথবা তিনি ঠিকানা গোপন করেছেন। লন্ডন ভূমি অফিসের রেকর্ডে এই ঠিকানায় কোনো সম্পত্তি তার নামে নেই।

বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী 108 Sheppey Road, Dagenham (RM9 4LB) ঠিকানার বাড়িটি ক্রয়ের ক্ষেত্রে Mortgage express নামের একটি অর্থ ঋন কোম্পানি থেকে ঋণের জন্য আবেদন করেন। এই আবেদনে তিনি নিজেকে লন্ডনের একটি কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত বলে দাবি করেন। মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে তিনি বছরে লন্ডনের স্থানীয় মুদ্রায় ৩৪ হাজার ৪৫০ পাউন্ড বেতন পান বলেও উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে।

ঋণের আবেদনে তিনি ২০০৩ সালের ১ জুন তারিখে এই বর্ণনা উল্লেখ করেন। অথচ তিনি তখন সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে কর্মরত একজন বিচারপতি। তিনি হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৩ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত অস্থায়ী বিচারপতি হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

আবেদনে বলা হয় সুপ্রিমকোর্টের আচরণ বিধি অনুযায়ী বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় ভিন্ন কোনো চাকরি করতে পারেন না। তিনি বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে ঋণের আবেদনে নিজেকে সেখানে একটি কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে দাবি করে আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছেন।

অভিযোগে আরো জানানো হয়, চলতি বছরের (২০১২ সালের) ২৫ জুন জিসান নাসিম নামে এক ব্যক্তি লন্ডনের আদালতে বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় দাবি করা হয় ওই ব্যক্তির কাছে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী নিজেকে একজন ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে পরিচয় দেন। ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে তিনি ওই ব্যক্তিকে লন্ডন ওয়েস্টমিনিস্টার কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন এবং বলেন এই কলেজের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওই মামলায় দাবি করা হয় বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারের পাশাপাশি নিজেকে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারক হিসাবে দাবি করে এবং তাকে কলেজটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। বিচারক শামসুদ্দিনের পরামর্শে সেই কলেজে ভর্তি হয়ে জিসান নাসিম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লন্ডনের স্থানীয় মূদ্রায় ১৫ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করেছেন। লন্ডনের The Northhampton County Court-এ দায়ের করা মামলাটির নম্বর হচ্ছে 2QT70489।

মামলার নোটিশ পাওয়ার পর গত ৭ জুলাই বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী আদালতে একটি সময়ের আবেদন জানান। মামলাটির নোটিশের জবাব দিতে সময়ে আবেদনে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্রটে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়া ভিত্তিহীন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে দাবি করে বলা হয় জবাবে জন্য পর্যাপ্ত সময়ের দরকার।

আবেদনে আরো জানানো হয়, বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে গিয়ে টেলিভিশন টক শো-তে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। বর্তমান শাসকদলের পক্ষে ও বিরোধী দলের বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন এসব টক শো-তে।

আবেদনে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের নির্যাতনে গত বছরের ২৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমদ নিহত হন। এই ঘটনার পর সেপ্টেম্বরে বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী লন্ডনে সেখানকার চ্যানেল আই-তে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। চ্যানেলটির লন্ডনের প্রধান নির্বাহী রিয়াজ আহমদ ফয়সলের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত এই টক শো-তে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বিভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্কিত বিষয়ে বক্তব্য দেন। পুলিশি নির্যাতনে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এম এউ আহমদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও তিনি বিশদ বক্তব্য রাখেন। তিনি সুস্পষ্ট করে বলেন, এই ইউ আহমদের বিভিন্ন ধরনের রোগ ছিল। পুলিশের নির্যাতনে নয়, তিনি রোগে মারা গেছেন। তদন্তাধীন ও বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতি এ ধরনের পাবলিক বক্তব্য প্রদান করে বিচারপতিদের জন্য তৈরি করা আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছেন।

আবেদনে বলা হয়, বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরীর গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতির কারণে আটকে দেয়ায় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের রাস্তায় কান ধরিয়ে উঠা-বসা করানো, রুল জারি করে আদালতে ডেকে এনে গালাগালি করা, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুল জারি করে তলব করা এবং তাদের অকথ্য ভাষায় গালি দেয়ার বিষয়টিও আবেদন উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এতে বিচারপতিদের জন্য সর্বশেষ প্রণীত আচরণবিধির ১, ২, ৩, ৯ ও ১১  লঙ্ঘিত হয়েছে বলেও দাবি করা হয় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতির কাছে করা আবেদনে।

No comments

Powered by Blogger.