বিনিয়োগ বাধা সরাতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ

বিনিয়োগের পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতাগুলো যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি, এ কাজে বেসরকারি খাতকে অংশীদার করতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সরকারের যত আনুকূল্য কেবল আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের দিকেই।


আমদানি-বিকল্প বা উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য নতুন কোনো প্রণোদনা কিংবা নীতি-সহায়তা নেই। বরং ঋণের উচ্চ সুদহার, শুল্কবৈষম্যসহ সরকারের নানা আর্থিক ও রাজস্বনীতি এ ধরনের শিল্পে বিনিয়োগের স্বাভাবিক ধারাকেও ব্যাহত করছে।
দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে আশাব্যঞ্জক নয় মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের নেতারা বলেছেন, উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন এ সরকার দেখছে, তা বাস্তবায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু আইএমএফ নির্দেশিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করে তা অর্জিত হবে না।
তিন বছর আগে বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি ছাড়া উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে না। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার উদ্ধৃত করে তিনি বলেছিলেন, ২০১৩ সালে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ১০ শতাংশে উন্নীত করে তা ২০২১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হলে অবকাঠামো খাতে অতিরিক্ত ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত ওই পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে।
এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ সরকারের একার পক্ষে সংস্থান করা অসম্ভব স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। পিপিপিকে কার্যকর করার জন্য কারিগরি সহায়তা খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, স্কুল, রাস্তাঘাট থেকে আয়ের নিশ্চয়তা নেই দেখে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এসব খাতে আগ্রহী হন না। তাই এ ধরনের প্রকল্পের জন্য ৩০০ কোটি টাকার ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড গঠনের কথা বলেছিলেন তিনি। সর্বোপরি দুই হাজার ১০০ কোটি টাকার অবকাঠামো বিনিয়োগ তহবিল গঠনের ঘোষণাও দিয়েছিলেন।
অতিরিক্ত এই ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কতটা গত তিন বছরে এসেছে তার কোনো খতিয়ান নেই। এ বিনিয়োগ আহরণের কোনো কর্মপরিকল্পনাও অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেননি। মূলত, প্রথম বাজেটের পর এ বিষয়ে তিনি আর উচ্চ-বাচ্য করেননি। পিপিপি নিয়ে বেসরকারি খাতে বেশ আগ্রহ তৈরি হলেও বেশি দূর এগোতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। তিন বছরে পিপিপি প্রকল্পের জন্য কেবল একজন সিইও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। পরপর তিনটি বাজেটে পিপিপির পুনরাবৃত্তি, বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি ও তহবিলের নাম বদল ছাড়া আর কিছু হয়নি। গত তিন বছরে পিপিপির বরাদ্দের একটি টাকাও খরচ হয়নি। পিপিপির আওতায় একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়নি, কিংবা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকল্প নির্ধারণ করে বেসরকারি খাতকে অংশীদার হতে আহ্বান জানানোও হয়নি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অনুমোদিত যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নাম পাল্টে প্রকল্পটিকে পিপিপির আওতাধীন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে পিপিপির আওতায় আট প্রকল্পের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তবে প্রকল্পগুলো কী এবং এগুলোতে বেসরকারি খাত থেকে কী পরিমাণ বিনিয়োগ সরকার আশা করে তার কোনো রূপরেখা নেই।
দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর এ সরকার গত সাড়ে তিন বছরেও বিদ্যুৎ খাতে বড় কোনো প্রকল্প পিপিপির আওতায় নিতে পারেনি। কয়লানীতিই এখনো প্রণীত হয়নি। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নতুন বিনিয়োগ আসেনি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি এখনো রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্থাপনের মধ্যেই সীমিত।
শিল্প স্থাপনে জমি না পাওয়ার সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এতে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে কৃষিজমি নষ্ট হওয়া যেমন অব্যাহত রয়েছে, তেমনি জমি আরো দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় নিবন্ধন করেও ফিরে যাচ্ছেন আগ্রহী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
জমি ও অবকাঠামোর চিরাচরিত এসব সমস্যা বহাল থাকার পাশাপাশি সরকারের স্ববিরোধী নীতি বিনিয়োগের গতিপথ রুদ্ধ করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের ব্যক্তিরা। মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করার স্লোগান বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দরকার, তা অর্জন করতে হলে সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। অথচ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, যা বিনিয়োগের স্বাভাবিক প্রবাহকেও ব্যাহত করছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দরসহ যোগাযোগ অবকাঠামোর যে দুর্বলতা, বিনিয়োগের পথে যেসব বাধা আবহমানকাল থেকেই ছিল, তা এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
সীমিত যে জাতীয় সঞ্চয় ব্যাংকগুলোতে জমা রয়েছে, তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতের কাড়াকাড়িতে বিনিয়োগের জন্য ঋণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ঋণ যদিও বা মেলে, তার উচ্চ সুদ দিয়ে কোনো শিল্প লাভজনকভাবে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ঊর্ধ্বতন গবেষক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি থাকলেও জিডিপির শতাংশের হিসাবে তা কমে গেছে। বেসরকারি খাত চাহিদামতো ঋণ পাচ্ছে না। সুদের উচ্চ হারের কারণে তাদের বিনিয়োগের খরচ বেড়ে গেছে, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
দুটি কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে মনে করেন এ গবেষক। প্রধান কারণ হলো, অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি উভয় বাজারেই চাহিদা কমে যাওয়া। এতে সার্বিকভাবে উৎপাদন খাতে তৎপরতা কমেছে। জ্বালানির অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের বাড়তি খরচ, যা উৎপাদন ও পরিবহনের ব্যয় বাড়িয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের গতিধারা শ্লথ হওয়াটাই স্বাভাবিক। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার যদি কম সুদে পুঁজির জোগান ও শিল্প স্থাপনের জন্য জমির নিশ্চয়তা দিতে পারত, তবুও বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আশ্বস্ত হতো।
বেসরকারি খাতের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে গতি আসছে না। গত অর্থবছরে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ নেওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে যে নগদ অর্থের ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ব্যাংকগুলো। উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগের খরচ বেশি। তা ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, সড়কসহ অবকাঠামোগত যেসব সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে, সেগুলো সমাধানেরও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
উন্নয়ন অন্বেষণের প্রধান নির্বাহী ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আইএমএফের ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য যে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছে, তার অন্যতম উপাদান ছিল ঋণপ্রাপ্তি সীমিত করা। ঋণের সুদের যে উচ্চসীমা ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক তা উঠিয়ে দিয়েছে। ফলে সুদ আরো বেড়ে গেছে। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল এমনিতেই কম, যা পাওয়া যায় তা-ও দুর্মূল্য। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ভ্রান্ত নীতির কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমেছে। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগও কমেছে।
তবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতি আসতে শুরু করেছে বলে জানালেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, মাঝখানে কিছু সময় ঋণের প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। এর কারণ, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে। জাহাজনির্মাণ শিল্পেও ঋণের চাহিদা রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসিগুলোর নিষ্পত্তি চলছে। সামনের দিনগুলোতে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ব্যাংকের এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
দেশে রেফ্রিজারেটরের বাজারের ৬০ শতাংশ ও মোটরসাইকেলের ২৫ শতাংশ ওয়ালটনের দখলে বলে জানান ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আশরাফুল আলম। দুঃখ করে এ শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদনকারীরা শক্তিশালী থাকে, আর আমদানিকারকরা থাকে দুর্বল। বাংলাদেশে এ চিত্র বিপরীত। আমরা যেন উৎপাদনে গিয়ে অপরাধ করে ফেলেছি।' তিনি বলেন, 'আমদানিকারক আছে দেড় শতাধিক। আমরা একটা কম্পানি, আমাদের কোনো অ্যাসোসিয়েশন নেই। সুতরাং আমাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।'
ড. রাশেদ তিতুমীর বলেন, এ দেশে কার্যকর শিল্পনীতি নেই, যা আছে তা হলো বাণিজ্যনীতি। দেশীয় শিল্প বিকাশের জন্য বাজেটে যেসব রাজস্ব নীতি সহায়তা থাকা দরকার এখানে তা নেই। কোন কোন পণ্য আমদানি করা দরকার, কোনগুলো দেশে উৎপাদিত হবে- সে রকম কোনো সমীক্ষাও হয়নি। পরিকল্পিতভাবে শুল্ককর ও ভর্তুকি সহায়তা দিয়ে দেশি শিল্পের বিকাশের ধারাবাহিক নীতি নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের সৃজনশীল চিন্তারও অভাব রয়েছে।
অবশ্য সরকারের মুখাপেক্ষী থেকে কোনো কালেই এ দেশে বেসরকারি খাতের বিকাশ হয়নি বলে মন্তব্য করেন নিউ এজ গ্রুপের চেয়ারম্যান এ এস এম কাশেম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সইতে হয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা টিকে থাকে, বিকশিত হয়। ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট, সুদের উচ্চ হার, অবকাঠামোর সমস্যা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্প স্থাপনের চেয়ে ব্যবসা করাই সহজ। তবু শিল্প হচ্ছে, প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে। হয়তো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না। অবকাঠামো সমস্যা নিরসন হলে, সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা পেলে বেসরকারি খাত হয়তো আরো ভালো করতে পারত।

No comments

Powered by Blogger.