কল্পকথার গল্প-আসছে সেতুর ঋণ, সামনে শুভদিন by আলী হাবিব

এখন তো আমাদের আনন্দ করার দিন। কারণ পদ্মা সেতুর ঋণ এখন আর আমাদের অধরা নয়। কেটে গেছে সব ভয়। জাইকা, এডিবি আছে, অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকও রাজি। যাদের ভাবা হচ্ছিল ঋণের অন্তরায় কিংবা সব অঘটনের কাজি- নির্বাসনে তাঁরা।


বোধ করি তাই কেটে গেছে সব ফাঁড়া। এখন ভালোয় ভালোয় কাজটা শুরু করা গেলে পরে সেতুর ফসল তোলা যাবে ঘরে। আপাতত মাথায় দুশ্চিন্তা রাখার নেই কোনো হেতু। আসছে বিশ্বব্যাংকের টাকা, পদ্মায় হবেই হবে মালটিপারপাস সেতু। ঋণ পাচ্ছি, তাই বিদেশের মাটিতেও দেখি আনন্দ-উৎসব হয়। আমাদের ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল নতুন একটি জয়। হয়তো অভিধানেও লেখা হবে নতুন এক শব্দ- ঋণজয়। ওদিকে ছিদ্রান্বেষী বিরোধীরা জব্দ এভাবেই হয়। আর কোনো চিন্তা নেই, এসে গেছে পদ্মা সেতুর ঋণ। কাজেই ভাবা যেতে পারে, এখন থেকে শুরু আমাদের নতুন দিন। তো কাজ শুরু করাই এখন সবচেয়ে জরুরি- কারণ হাতে সময় অল্প। এই সুযোগে সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক ঋণ-জাতকের গল্প।
অনেক অ-নে-ক দিন আগের কথা, তখন শ্রাবন্তীপুর নামে একটি নগররাজ্য ছিল। সেই নগর রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। সে আমলের রাজারা খুব মুনি-ঋষিভক্ত হতেন। তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হতো। সেবা-যত্নের ত্রুটি থাকত না। মুনি-ঋষিরা প্রফুল্লচিত্তে সেবা গ্রহণ করতেন। তো সেই বিম্বিসার রাজ্যে এলেন এক মহাপুরুষ। তিনি আবার এককালে ছিলেন রাজপুত্র। সংসার ত্যাগ করে বিবাগি হয়েছেন। কোনো এক শুভ কিংবা অশুভ লগ্নে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। রাজপোশাক ছেড়ে গেরুয়া ধরেছেন। কিন্তু সংসার তাঁকে ছাড়েনি। সন্ন্যাসী রাজপুত্র নিজের রাজবাড়ি ছাড়লেও রাজ-রাজড়ার আহ্বান তো আর ফেলতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। যেমন এসেছেন শ্রাবন্তীপুরে। নগরজুড়ে ধুম পড়ে গেছে। কাছাকাছি যেসব রাজ্য আছে, সেখান থেকেও অনেকে এসেছেন। মহাপুরুষের সন্তুষ্টি অর্জনে সবাই সচেষ্ট। রাজবাড়ির সদর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নগরীর গরিব লোকদের ভিড়। দেদার খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। দুপুরের পর যখন ভিড় কমে এসেছে তখন সন্ন্যাসী একটু ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ সেখানে হাজির এক দরিদ্র নারী। নারীর আকুতিতে সন্ন্যাসীর ধ্যানভঙ্গ হলো। তিনি চোখ মেললেন। জানতে চাইলেন, 'বৎসে কী তোমার প্রার্থনা?' নারী তার পরিচয় দিয়ে বলল, 'আমি এক দুঃখী। আপনার নাম ও খ্যাতি শুনে অনেক দূর থেকে এসেছি। শুনেছি আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। লোকে বলে আপনি সিদ্ধ পুরুষ। অসাধ্য সাধন কেবল আপনার দ্বারাই সম্ভব। আমার একমাত্র ছেলেটি মারা গেছে। দয়া করে আপনি তাকে বাঁচিয়ে তুলুন।' নারী ঘরের বাইরে চলে গেল। আবার ঘরে ঢুকল একটি শিশুর মৃতদেহ নিয়ে। সন্ন্যাসী মহাপুরুষ এককালে রাজপুত্র ছিলেন। সাংসারিক রীতিনীতি তাঁর জানা আছে- এ ধরনের ঘটনা কেমন করে সামলাতে হয়, সেটা বিলক্ষণ জানা। তিনি বললেন, 'বৎসে, তোমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে পারি। কিন্তু একটি দুর্লভ ওষুধ সংগ্রহ করতে হবে।' নারী বলল, পুত্রের জীবনের জন্য তিনি যেকোনো জায়গায় যেতে রাজি। ওষুধের নাম বললেই তিনি সেটা সংগ্রহ করে আনবেন। বলা বাহুল্য, সে আমলে চিকিৎসাব্যবস্থা আজকের দিনের মতো উন্নত হয়নি, নির্ভর করতে হতো বনজ গাছগাছালির ওপর। সন্ন্যাসী বললেন, 'তোমার ছেলেকে বাঁচাতে সাদা শর্ষে লাগবে।' ওষুধের নাম শোনামাত্র নারী ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পেছন থেকে ডাকলেন সন্ন্যাসী। বললেন, 'আমার কথা শেষ হয়নি। এই সাদা শর্ষে তোমাকে ভিক্ষে করে আনতে হবে। যেকোনো জায়গা থেকে সাদা শর্ষে আনলে চলবে না।'
সন্ন্যাসীর কথা শুনে নারী বলল, 'আপনি বলুন, কার বাড়ি থেকে শর্ষে আনতে হবে বলুন। জ্ঞানীর বাড়ি থেকে, ধনীর বাড়ি থেকে নাকি পুণ্যবানের বাড়ি থেকে?'
সন্ন্যাসী বললেন, 'এটা দৈব ওষুধ। কাজেই এই সাদা শর্ষে সে-ই ভিক্ষা দিতে পারবে, যার কোনো ঋণ নেই।'
নারী বলল, 'এ আর এমন কী কঠিন কাজ। আমি চললাম। এ রাজ্যে অনেক ধনী লোকের বাস। কাজেই ঋণ নেই এমন লোকের বাড়ি থেকে সাদা শর্ষে নিয়ে খুব শিগগিরই আমি ফিরব।'
আশায় বুক বেঁধে ছেলের মরদেহ নিয়ে নারী বেরিয়ে পড়ে। রাজবাড়ি থেকে কিছু দূর যেতেই একটি বাড়ি। সেখানে ঢোল বাজছিল। নারী ভাবল, ওই বাড়িতে গেলেই সাদা শর্ষে পাওয়া যাবে। সে ওই বাড়িতে গিয়ে এক মুঠো সাদা শর্ষে চাইল। বাড়ির কর্তা এক মুঠো সাদা শর্ষে নিয়ে হাজির। শর্ষে নেওয়ার আগে সন্ন্যাসীর দেওয়া শর্তের কথা মনে পড়ে গেল তার। নারী জানতে চাইল, বাড়ির কর্তার কোনো ঋণ আছে কি না। কর্তা বললেন, ঋণ আছে কি না জানতে না চেয়ে বরং জানতে চাও, আমি আছি কি না? নারী বলল, আপনার বাড়িতে যে উৎসবের বাজনা বাজছে! বাড়ির কর্তা বললেন, 'তুমি যাকে উৎসবের বাজনা বলছ এটা আসলে নিলামের বাজনা। পাওনাদার আমার বাড়ি বিক্রি করে নিতে এসেছে।' মনে বড় দুঃখ পেয়ে ভিক্ষা না নিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করল নারী। এবার সে হাজির হলো একটি বড় দোকানের সামনে। মনে মনে ভাবল, এখানে তার অভীষ্ট ভিক্ষা মিলবে। দোকানের মালিককে সে জিজ্ঞেস করল, 'আপনার কি কোনো ঋণ আছে?'
দোকানের মালিক অবাক বিস্ময়ে বললেন, 'তুমি কি আমাকে ব্যবসায়ী হিসেবে গণ্য করো না?'
নারী বলল, 'তাহলে আপনার ঋণ আছে?'
হ্যাঁ-সূচক জবাব শুনে সেখান থেকে চলে গেল সে। এভাবে সে শ্রাবন্তীনগরের সব বাড়ি ঘুরেও অভীষ্ট ভিক্ষা পেল না। এমন কোনো বাড়ি নেই, যে বাড়ির কর্তা ঋণী নন। নারী ভাবল, সে কোনো ধনী লোকের কাছে ভিক্ষা চাইতে যাবে না। ভিক্ষুকরা তো অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে চলে। সে কোনো এক ভিক্ষুকের কাছ থেকে সাদা শর্ষে ভিক্ষা চাইবে। কিন্তু নগরীতে এমন কোনো ভিক্ষুক পাওয়া গেল না, যার ঋণ নেই। এক ভিক্ষুক আরেক ভিক্ষুকের কাছে ঋণী। ভিক্ষুকদের মধ্যেও ঋণী মহাজন, ধনী-নির্ধন আছে। অসহায় নারী হিসাব করে দেখল, রাজ্যের এক কৃষক আরেক কৃষকের কাছে ঋণী। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের কাছে ঋণী। রাজা মহারাজার কাছে ঋণী। ঋণ নেই এমন কাউকেই পাওয়া গেল না। হতাশ, ভগ্নহৃদয়ে নারী আবার ফিরে এলো রাজবাড়িতে। তার ছেলের প্রাণ ফিরে পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। সন্ন্যাসীর সামনে আসতেই সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করলেন, 'সাদা শর্ষে পেলে?'
নারী জানাল, সাদা শর্ষে অনেকই পাওয়া গিয়েছিল, তবে ঋণ নেই এমন কাউকেই পাওয়া গেল না।
সন্ন্যাসী বললেন, 'একেই বলে কর্মফলের চক্র। এ থেকে কারো নিস্তার নেই।'
নারী বলল, 'আমার ছেলের তাহলে বাঁচার কোনো আশা নেই।'
সন্ন্যাসী বললেন, 'আমি তো দেখি না।'
নারী তার ছেলের মৃতদেহ নিয়ে বেরিয়ে গেল।
গল্প এখানেই শেষ।
ঋণের কারণে গল্পের ওই নারীর ছেলে প্রাণ ফিরে পায়নি। কিন্তু আমাদের পদ্মা সেতুর আশা কিন্তু প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঋণে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের কাব্যজগতেও প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। হালের এক কবি লিখেছেন, 'সামনে নতুন দিন/ব্যাংক দিয়েছে ঋণ/দূর হয়েছে ভয়/ঋণ করেছি জয়।'

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.