বেগম জিয়ার দিনাজপুর জনসভার পোস্টমর্টেম ॥ কান ধরে উঠবস করানো বক্তব্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া -হতাশ জামায়াতের নেতাকর্মীরা by সাজেদুর রহমান শিলু

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের রবিবার দিনাজপুরের জনসভায় বেগম জিয়ার একটি বক্তব্য নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ দিনাজপুরবাসীর মধ্যে। ঐ জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, ‘সরকারী দলের লোকজনদের যেখানেই পাবেন কান ধরে ওঠ-বস করাবেন।


’ এছাড়া রবিবারের জনসভাকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ এই জনসভাতেই বেগম জিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করার কথা ছিল। তা না করায় খোদ বিএনপির লোকজনই হতাশ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তারা উন্মুখ হয়েছিল এই কর্মসূচীর আশায়। এদিকে লোক সমাগমের দিক থেকে স্মরণকালের বৃহত্তম এই জনসভায় কী কারণে এত লোকের আগমন ঘটল তা নিয়েও হিসাব মেলাতে ব্যস্ত দিনাজপুরবাসী।
গোর-এ-শহীদ মাঠের ১৮ দলীয় জোটের জনসভার পর সোমবার পর্যন্ত দিনাজপুরে ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হয় খালেদা জিয়ার ঐ বক্তব্য ‘সরকারী দলের লোকজনদের যেখানেই পাবেন কান ধরে ওঠ-বস করাবেন।’ যারা সশরীরে জনসভায় যাননি তাঁরা অন্যদের কাছে যাচাই করছেন, সত্যিই বেগম জিয়া এমন বক্তব্য রেখেছেন কি না। অনেকে নিজ কানে শোনার পরও তা বিশ্বাস করতে চাননি। এ ব্যাপারে দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি চিত্ত ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মুখে এই বক্তব্য রাজনৈতিক শিষ্টাচারবর্জিত দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য মোঃ ইকবালুর রহিম বলেন, ‘মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতার মুখে এ ধরনের বক্তব্য আশা করেনি দিনাজপুরবাসী। তিনি এই দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে দিনাজপুরবাসীকে হতাশ করেছেন।’ দিনাজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সৈয়দ মোকাদ্দেস হোসেন বাবলু বলেন, ‘বেগম জিয়ার কাছে আমরা এ ধরনের বক্তব্য কোনদিন আশা করিনি। বক্তব্য দেয়ার সময় তাঁকে আরও সংযত হতে হবে।’ দিনাজপুর আদালতের পাবলিক প্রসিউকিউটর এ্যাডভোকেট মোঃ হামিদুল ইসমলাম বলেন, ‘বেগম জিয়ার এমন বক্তব্যের আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানাই।’ একই সুরে কথা বললেন সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুল লতিফ। দিনাজপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আজিজুল ইমাম চৌধুরী বলেন, ‘বিরোধী দলের নেতার মুখে এ ধরনের বক্তব্য শোভা পায় না। এতে করে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়।’
এদিকে জনসভায় বেগম জিয়া পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা না করায় ১৮ দলীয় নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। ওই জনসভার অনেক আগে থেকে বিএনপিসহ জোট নেতারা বলেছিলেন, দিনাজপুর থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। জোটের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মতো সাধারণ মানুষও উৎসুক হয়েছিলেন নতুন আন্দোলন কর্মসূচী শোনার জন্য। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বেগম জিয়া ঐ জনসভায় আন্দোলনের কোন কর্মসূচী ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে ছোট গল্পের মতো ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’-এর মতো হয়েছে ১৮ দলীয় জোটের দিনাজপুরের বিশাল জনসভার। সাধারণ জনতার মতো অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে ঘরে ফিরে যায় জোটের তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা না করায় বিএনপির ওপর বেজায় নাখোশ হয়েছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা জামায়াতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক ও বিচার চলার কারণে তারা বর্তমানে বেশ কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। গ্রেফতারের ভয়ে প্রকাশ্যে তারা মিটিং-মিছিল করতে পারছে না। অধিকাংশ জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মী গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা বিএনপির ঘাড়ে ভর করে আবার প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফিরতে চায়। আর প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফিরতে হলে চাই নতুন কোন সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী। কিন্তু রবিবার দিনাজপুরের জনসভায় বেগম জিয়া নতুন কোন আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা না করায় আপাতত তাদের মনোকামনা পূর্ণ হয়নি।
দিনাজপুরজুড়ে এখন চলছে রবিবার অনুষ্ঠিত হওয়া ১৮ দলীয় জোটের বিপুলসংখ্যক লোকসমাগম হওয়ার হিসাব-নিকাশ। দিনাজপুরে স্মরণকালের মধ্যে বিশাল এই জনসভার লোকসমাগম ঘটানোর নেপথ্যে রয়েছে প্রধানত ৪টি কারণ। প্রথমটি হলো ‘আওয়ামী লীগের দুর্গ’ বলে পরিচিত দিনাজপুর জেলায় বিশাল শোডাউন করে সেই দুর্গে ফাটল ধরানো। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়ার বড় বোন বেগম খুরশীদ জাহান হক (চকোলেট আপা) শক্তহাতে দিনাজপুরে বিএনপির হাল ধরার কারণে এ জেলায় বিএনপি কিছুটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বে দিনাজপুরের ৬টি আসনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত পায় ৫টি আসন। তিনি মারা যাওয়ার পর সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দিনাজপুরে বিএনপি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনই পুনরায় চলে যায় আওয়ামী লীগের দখলে। যা বিশেষত বিএনপির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। বিএনপি চেয়ারপার্সন নিজেকে দিনাজপুরের মেয়ে বলে দাবি করেন। তার সেই দিনাজপুরেই বিএনপির এমন পরাজয় সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি দলটির নীতিনির্ধারকরা। যার কারণে দিনাজপুরের জনসভা সফল করার জন্য তারা সর্বোচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ করে। দিনাজপুর ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা থেকে ট্রাক ও বাসে করে লোক আনা হয়। টাকা খরচ করা হয় পানির মতো।
দ্বিতীয় কারণটি হলো রবিবারের জনসভাটি ছিল মূলত আগাম নির্বাচনী জনসভা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেও রবিবার দিনাজপুরের ওই জনসভা প্রমাণ করে ১৮ দলীয় জোট ভিতরে ভিতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই জনসভায় দেখা গেছে এই অঞ্চলের জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হাজার হাজার কর্মী দিয়ে শোডাউন করে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য নেত্রীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এদিকে দলের একটি সূত্র জানান, আগামী নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া দিনাজপুর সদর আসন থেকে দাঁড়াতে পারেন। তাই এই জনসভায় ব্যাপক লোকের সমাগম ঘটিয়ে বিএনপির শক্তি ও সামর্থ্য জানিয়ে দেয়া হলো।
তৃতীয় কারণটি হলো, জামায়াত-শিবিরের তৎপরতা। গ্রেফতার ও মামলার ভয়ে অধিকাংশ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা আত্মগোপন করে আছে। বন্ধ রয়েছে তাদের প্রকাশ্যে গণযোগাযোগ। রবিবারের জনসভাকে কেন্দ্র করে তারা তাদের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একত্রিত করার সুযোগ পায়। জনসভায় আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা না করায় দলটি নাখোশ হলেও দীর্ঘদিন পর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একত্রে সংগঠিত করতে পারাটাই অনেক লাভ বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। জামায়াতের দাবি, রবিবারের জনসভায় প্রায় অর্ধেক লোক ছিল তাদেরই।
চতুর্থ কারণ ছিল, জনসভায় উপস্থিত মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ শুধু সরকারবিরোধী আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী শুনতে গিয়েছিলেন। নিজ কানে আন্দোলন কর্মসূচী শোনার জন্য এসব মানুষ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জনসভাস্থলের আশপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণেই রবিবার দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ মাঠে ১৮ দলীয় জোটের জনসভায় এত লোকের সমাগম হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.