চরাচর-পান-সুপারি by সাজ্জাদ কবীর

পান আমাদের দেশি ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদিকালে এমন বাড়ি প্রায় ছিল না বললেই হয়, যেখানে পান খাওয়া হতো না। জমিদার থেকে জমাদার বা রাজা থেকে প্রজা- সবাই পান-সুপারির ভক্ত। হাতে গুনে হয়তো কম লোকই পাওয়া যেত যারা পান খেত না।


পরে যত সাহেবি কেতার প্রচলন বেড়েছে, ততই পান খাওয়ার চলটা উঠে গেছে। অথচ একটা সময় ছিল গ্রামগঞ্জে এমনকি নগরেও অতিথি বাড়িতে এলে প্রথমেই তাকে আপ্যায়ন করা হতো পান-সুপারি দিয়ে। আগের দিনে বাড়ির গিনি্নরা বেশ আয়েশ করে বসতেন পানের বাটা নিয়ে। পানের বাটা হয়তো কেউ কেউ এখন চিনবেন না। তাঁদের জন্য বলতে হয় পানের বাটা হলো পান, সুপারি, চুন, খয়ের, জর্দা, সুপারি কাটার জন্য জাঁতি অর্থাৎ পান খাওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম রাখার পাত্র। পাড়া-প্রতিবেশী যিনিই বেড়াতে আসুন না কেন তাঁকে পান খাওয়ানো হতো। ইদানীং সেই পানেও এসেছে বাহার। নানা কায়দার পান এখন পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা শহরে এবং সেসব পান বিয়ে বা বড় কোনো অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হচ্ছে অতিথিদের। এসব পানে সুপারি ছাড়াও থাকে নানা ধরনের মসলা। পানের খিলি মোড়া থাকে রুপালি তবক দিয়ে। হরেক রকম মসলা দিয়ে পান আগে রাজা, জমিদার অথবা সেই স্তরের মানুষদের খাওয়াদাওয়ার অংশ ছিল। ক্রমে সেটা সাধারণের নাগালে এসেছে। তবে মানেগুণে নিশ্চয়ই অনেক হেরফের হয়েছে।
পুরান ঢাকায় নবাবরা যখন নবাবি করতেন, তখন সেখানে নানা রকমের মসলাদার পান পাওয়া যেত। সেখান থেকে ক্রমে সেটা ছড়িয়েছে নতুন ঢাকায়। একসময় স্টেডিয়ামের নিচে একটা দোকানে বাহারি পান পাওয়া যেত। তবকে মোড়া নানা রকম মসলা দেওয়া পান অনেকেই কিনে খেতেন সে সময়। হালে সেই পান আবার ফিরে এসেছে নতুন মোড়কে। যদিও পুরান ঢাকার 'নবাববাড়ির পানের দোকান' নামের বিখ্যাত দোকানটি এ রকম মসলাদার পান বিক্রি করছে অনেক দিন ধরে। লায়ন সিনেমার কাছে নবাববাড়ির মূল ফটক। কাপড়ের দোকানের ভিড়ে ফটকের চেহারা বলতে গেলে দেখাই যায় না। সেই ফটকের পাশেই ছোট্ট দোকানের পান খেয়ে তারিফ না করে উপায় নেই। সে দোকানের পান আসে বেতকা, বিক্রমপুর, কুষ্টিয়া আর পাবনা থেকে। সেখানে খাওয়ার জন্য পান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের ছাঁচি পান। সপ্তাহে এক দিনই এই পান আসে ঢাকায়। কারণ রপ্তানির জন্য বিদেশে পাঠানো হয় নির্দিষ্ট ওই দিনে। এই দোকানের পানের দাম ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। মিষ্টি পানে কোনো রকম জর্দা ব্যবহার হয় না। প্রায় ৩০ ধরনের মসলা দিয়ে বানানো হয় এই পান। মূল্যভেদে মসলার হেরফের হয়। ধানমণ্ডির ৪ নম্বরে প্রথম পান-সুপারির দোকান চালু হয়। তখন অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে এত দাম দিয়ে মানুষ পান খাবে কি না! কারণ সেখানে পানের দাম প্রতি খিলি ২৫ থেকে শুরু করে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। পরে দেখা গেল, শুধু সেটিই নয়, ৯ বছরে আরো চারটি শাখা খোলা হয়েছে পান-সুপারির। বসুন্ধরা সিটি মার্কেটে একটি, বনানীতে একটি এবং চতুর্থটি এয়ারপোর্টে। এ দোকানে মোট ১৬ রকমের পান বিক্রি হয়। ২৫ টাকার পানের নাম হচ্ছে পান-সুপারি লাল। পানের মসলায় সাধারণত মিষ্টিজাতীয় জিনিস ব্যবহার হয় বেশি। মূল্যভেদে ১৬ থেকে ১৮০ রকম মসলা ব্যবহার হয় এসব পানে।
সাজ্জাদ কবীর

No comments

Powered by Blogger.