গণতন্ত্রের পথে মিসর

কখনো রাজতন্ত্র, কখনো গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র_এভাবেই দীর্ঘদিন চলে আসছে মিসর। তা রাজা ফারুকের আমল হোক কিংবা সে পথ বেয়ে নাসের, আনোয়ার সাদাত অথবা হোসনি মুবারকের আমলই হোক; কোনো হেরফের নেই ওখানে। মূল কথা, মিসর প্রকৃত গণতন্ত্র দেখেনি কখনো।


অথচ দেশটির শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রয়েছে বিশাল ঐতিহ্য। পাঁচ হাজার বছরেরও প্রাচীন সেই ঐতিহ্য। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে হালের পশ্চিমা সংশ্লিষ্টতা। মুক্তজীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি। আরব অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমের মিশেল এই জীবনধারা ওই অঞ্চলের আর সব দেশ থেকে দেশটির অবস্থান একটু ভিন্নতরও বটে। কিন্তু গণতন্ত্রহীন জীবনব্যবস্থা যে মানুষকে জীবনের আসল স্বাদ দিতে ব্যর্থ হয়, সেই ব্যর্থতার ভার জনগণের কাঁধ থেকে সরানোর দায় নেয়নি কেউ। আর আজকের যে টালমাটাল অবস্থা, তার জন্যও সেই জনচাহিদা পূরণে অনীহা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের আড়ালে চলনবলনে পশ্চিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তজীবন গড়ার ইচ্ছাশক্তি তৈরি হওয়ার ব্যাপারটিও অনুল্লেখ্য নয়। সেই মিসরে এবার গণতন্ত্রের জনচাহিদা তৈরি হয়েছে। তাহরির স্কয়ার আজ সত্যিই মুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাখো মানুষ সেই মুক্তির গানই গাইছে ওখানে সমবেত হয়ে। তাদের মারমুখী অবস্থা মিসরের হাজার বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভেঙে সেখানে নতুন সরকারব্যবস্থা কায়েম করবে কি না সেই প্রশ্নের জবাব এখনই পাওয়া কঠিন। কারণ, যারা এই আন্দোলনে আছে, তাদের পেছনে যে সেখানকার মুসলিম ব্রাদারহুড কতটা শক্তি জুগিয়ে চলেছে, তা এখনো স্পষ্ট করে বলা যায় না। শুধু তা-ই নয়, বছরের পর বছর সেখানে সেনাশাসন চলার কারণে সাধারণ মানুষও অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেনাশাসনে। তাহরির স্কয়ারে সমবেতদেরও কেউ কেউ তাই স্পষ্টতই বলেন, তাঁরা নতুন একজন জেনারেলের অপেক্ষা করছেন। যিনি নাকি তাঁদের দেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন। গণ-আন্দোলনের জোয়ারে টিকতে পারবেন না হোসনি মুবারক_এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তিনি পদত্যাগের ব্যাপারে কিছুটা সায়ও দিয়েছেন। এটা কি হোসনি মুবারকের সমর্থক শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে না কি অন্য কিছু? বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু হোসনি মুবারকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কোন কারণে? হোসনি মুবারককে ক্ষমতা ছাড়ার পরামর্শ দেওয়ার পর স্পষ্ট হয়ে যায় যে তাঁর আর ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা নেই। আবার তিনি পদত্যাগের আভাস দিতে গিয়ে যে আশঙ্কার কথা বলেছেন, তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, দীর্ঘকাল গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকার কারণে সেখানে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। আর এই সুযোগটিই যে অগণতান্ত্রিক শক্তির মূল ভিত্তি। ফলে হোসনি মুবারকের পরিবর্তে কোন নেতা ক্ষমতাসীন হবেন, মিসরবাসীকে তা নির্বাচন করতে গেলেও বেগ পেতে হবে। এমনকি আপৎকালীন সরকার গঠন করতে গেলেও কোনো না কোনোভাবে বর্তমান সরকারের লোকজনকে সেখানে রাখতেই হবে। যদি বলা হয়, নির্বাচনেও তাদের অনেকে ফিরে আসতে পারে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তার পরও মনে করার যুক্তি আছে যে সেখানকার মানুষ গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তা কায়েমের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। হয়তো পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র সেখানে প্রতিষ্ঠা না-ও হতে পারে, তবে গণতন্ত্রের পথ তৈরি হবে এটা মনে করা যায়। সেই পথ ধরেই এগিয়ে যাক মিসর। আর কোনো প্রাণহানি যাতে সেখানে না ঘটে, সেই প্রত্যাশা সবার।

No comments

Powered by Blogger.