নাসার নভোচারীর সাক্ষাৎকার-পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতেই মহাকাশ গবেষণা by রাহীদ এজাজ ও রাজীব হাসান

‘প্রথমবার মহাকাশে পৌঁছানোর পর নভোযানের জানালা থেকে পৃথিবীর ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বসবাসের জন্য যে গ্রহটা আমরা পেয়েছি, তার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর এই পৃথিবীটাকে আরও উন্নততর বসবাস উপযোগী করতেই তো মহাকাশের সব গবেষণা।


পরিবেশ, খনির সন্ধান কিংবা ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস, ওষুধের আবিষ্কার ইত্যাদি গবেষণাই মানবতার ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ।’
মার্কিন নভোচারী রোনাল্ড জে গারান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মহাকাশ অভিযান ও লক্ষ্যপূরণের কথা এভাবেই তুলে ধরেন। গতকাল বিকেলে গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেন নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন, স্বপ্নপূরণ ও আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়ে।
দুবার সফল মহাকাশ অভিযানের পর মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার এ নভোচারী সম্প্রতি গড়ে তুলেছেন ‘ফ্রাজাইলওয়েসিস’ নামের একটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, যার লক্ষ্য পৃথিবী নামের ‘বিপন্ন মরূদ্যান’কে আরও মনোরম ও টেকসই করে তোলা। আর উন্নততর পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে তিনি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন সামাজিক ব্যবসার প্রক্রিয়ায়। দারিদ্র্যের অভিশাপের পাশাপাশি পানি, জ্বালানিসহ মানবজীবনের প্রাত্যহিক সমস্যার টেকসই সমাধানে সামাজিক ব্যবসার মতো একটি অর্থনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়া কার্যকর বলেই তাঁর বিশ্বাস।
’৬৯-এ চাঁদে মানুষের পদচারণের বছরটিতে আট পেরোনো কিশোর রন গারান। বাড়িতে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে সাদাকালো টিভিতে দেখা দৃশ্য বুনে দিয়েছিল নভোচারী হওয়ার স্বপ্নের বীজ। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যোগ দেন মার্কিন বিমানবাহিনীতে। আর নাসায় যোগ দেন ২০০০ সালে। দীর্ঘ আট বছরের অপেক্ষার পর তাঁর জীবনে আসে সে মাহেন্দ্রক্ষণ—মহাকাশ অভিযান।
কেমন ছিল প্রথম মহাকাশ যাত্রা? রনের উত্তর, ‘এককথায় বলতে গেলে অভূতপূর্ব! এমন এক অসাধারণ গ্রহে বাস, সে তো নভোযানের জানালা দিয়ে বাইরে না তাকালে বোঝার উপায় ছিল না। যতবারই নভোযানে চড়েছি, মুগ্ধ হয়েই সে দৃশ্য দেখে চলেছি। এ মুগ্ধতা যেন শেষ হওয়ার নয়।’
মহাকাশে প্রথম দফায় দুই সপ্তাহ ও পরে প্রায় ছয় মাস কাটিয়েছেন রন গারান। এ অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর মতে, ‘স্বল্প ও দীর্ঘ সময়ে অবস্থানের ফারাকটা খুব স্পষ্ট। তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ আর ছয় মাস মহাকাশে থাকার তফাৎটাই আলাদা। দীর্ঘ সময়জুড়ে মহাকাশে অবস্থানে আপনি সহজেই টের পাবেন পৃথিবীর পরিবর্তন; বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তন, বরফ গলে পড়া সবকিছুই।’
দিনে ১৬ বারের পালাবদল: পৃথিবীতে যেখানে ২৪ ঘণ্টায় দিনরাতের পরিবর্তন হয়, মহাকাশে তা ঘটে দিনে ১৬ বার। দেহমনে এ পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে মার্কিন নভোচারী বলেন, ‘প্রতি ৪৫ মিনিটে এ পরিবর্তন সবচেয়ে বড় প্রভাবটা ফেলে মনের ওপর। এত ঘন ঘন পরিবর্তন আপনার মনঃ-সংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এটা বুঝে শুরুতে দিনের বেলা জানালার কাছে যেতাম না। পরে একসময় নিজের শরীরটা ঘড়ির মতো কাজ করতে শুরু করে। আর শারীরিক পরিবর্তনটা হচ্ছে—এমন অবস্থায় ঘুমানোটা রীতিমতো শুরুতে দুঃসাধ্য। অবশ্য একসময় গা-সয়ে যায়।’
মহাকাশ গবেষণায় বিনিয়োগের যৌক্তিকতা: রন গারান মনে করেন, ‘বছরজুড়ে মহাকাশে যেসব গবেষণা হচ্ছে তা সরাসরি পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, নতুন শস্য উৎপাদন কিংবা শস্যের উৎপাদন বাড়ানো, নতুন ওষুধের আবিষ্কার, সুপেয় পানি সরবরাহ, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের আগাম পূর্বাভাস—এসব নিয়ে যেসব গবেষণা মহাকাশে হচ্ছে, তা অন্তত সেখানে ছাড়া আর কোথাও করার সুযোগ ছিল না। কাজেই এটা ভাবার কারণ নেই যে, আমরা টাকাটা কোথাও ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি। কাজেই যে টাকাটা খরচ করছি, সেটা কয়েক গুণে ফিরে আসছে। আগামী দিনের মানবতার জন্যই এটা আমরা বিনিয়োগ করছি।’
ভিন গ্রহে বাস: আগামী দিনে মানুষ ভিন গ্রহে বাস করবে কি না, জানতে চাইলে নাসার এ নভোচারী বলেন, ‘আমি মনে করি কোনো একসময় মানুষ ভিন গ্রহের কোথাও বসবাস করতে শুরু করবে। এটা কাল করবে আমি বলছি না। তবে কোনো একদিন হবেই, আর সে জন্যই আমরা কাজ করছি।’
রন গারান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, একদিন উড়োজাহাজে চড়ার মতোই সহজ হয়ে উঠবে মহাকাশযাত্রা। তিনি বলেন, মহাকাশ নিয়ে ইদানীং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। মহাকাশে আরও বেশি লোকজনের যাওয়ার জন্য এরা কাজ করছে। আমার বিশ্বাস, মহাকাশে যাওয়াটা একসময় উড়োজাহাজে চড়ার মতো সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। এটা লোকজনের যাওয়ার একটা সহজ গন্তব্য হয়ে উঠবে। গত মাসে স্পেসএক্স নামে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান মহাকাশযাত্রা করেছে।
শুরুতে কঠিন পরে বেশ মজার: রন অকপটে স্বীকার করলেন, শুরুতে মহাকাশে ঘুমানোটা খুব কঠিন। তবে দীর্ঘ সময় থাকলে পরে বোঝা যায়, ব্যাপারটা কত সহজ। কারণ, আপনাকে পাশ ফেরা বা বিশেষ কোনো কসরত করতে হচ্ছে না। ভেসে ভেসেই আপনি সেরে ফেলছেন ঘুমানোর কাজটি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, মহাকাশ থেকে ফিরে পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক মাস লেগে যায়।
ছবি তোলা আর গানে বিনোদন: তাঁর মতে, ‘মহাকাশে বিনোদনের বড় অংশটা জানালার বাইরে চোখ রাখা আর ছবি তোলা। এর বাইরে মিউজিক সিস্টেমে গান শোনা, ছবি দেখে সময় কাটাতে হয়। তিনি জানালেন, মহাকাশে থাকার সময় বাংলাদেশের ছবি তুলেছি, আগামীকাল সামাজিক ব্যবসা সমাবেশে সেগুলো দেখাব।’
বই পড়ে সামাজিক ব্যবসায়: প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় রন গারান জানালেন, ইতিমধ্যেই তিনি পড়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সব কটা বই। সর্বশেষ মহাকাশ অভিযানের সময় তিনি সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর লেখা ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইথআউট পভার্টি। দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ তাঁকে মুগ্ধ করেছেন। তাই গত বছর সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনে যোগও দেন।
সামাজিক ব্যবসা নিয়ে মুগ্ধতার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্য বলুন কিংবা পানি, জ্বালানিসহ মানবিক সব প্রয়োজন টেকসই উপায়ে মেটাতে হলে দাতব্য পদ্ধতি কাজ করবে না। এ জন্য চাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ এমন কিছু আপনি করবেন, যাতে ব্যবসাও হবে, সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনও হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সামাজিক ব্যবসা আমাকে আকৃষ্ট করেছে।’
রন বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমি জার্মানিতে গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাবে যাই। সেখানে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধতা বেড়েছে। অনেক নতুন কিছু জেনেছি। আমাদের পৃথিবীটাকে আরও কতটা সুন্দর করে তোলা যায়, সেটি জেনেছি।’
‘বাংলাদেশ সম্পর্কে আগে থেকেই জানতাম। তবে কখনো আসা হয়নি। এবার আসা হলো আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সামাজিক ব্যবসা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এ অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণের জন্য ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ’, বললেন রন গারান।

No comments

Powered by Blogger.