পানিবন্দি চট্টগ্রাম, রেল-বিমান বন্ধ-রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন

অবিরাম প্রবল বর্ষণের ফলে পানিবন্দি হয়ে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরজীবন। গতকাল মঙ্গলবার দিনভর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কারণে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়।


সন্ধ্যার পর ভাটিয়ারী ও কুমিরা স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে একটি সেতু ভেঙে যাওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে বিকেলে বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করায় শাহ আমানত বিমানবন্দরে আটকা পড়েন পাঁচটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের অন্তত দেড় হাজার যাত্রী। থমকে যায় অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ (ইপিজেড) এলাকার স্বাভাবিক কার্যক্রম। আগের দুই দিনের মতো গতকালও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বহির্নোঙরে থাকা জাহাজ থেকে কোনো পণ্য খালাস হয়নি। সন্ধ্যার পর নগরীর অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলে জনজীবনে দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়।
রেল যোগাযোগ বন্ধের কথা স্বীকার করে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার এম শামসুল আলম গতকাল রাত পৌনে ৯টায় কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভাটিয়ারী ও কুমিরা স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি সেতু ভেঙে যাওয়ায় রেল যোগাযোগে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রামের আশপাশের এলাকা ও জেলাগুলোও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে। বান্দরবানে শঙ্খ নদ ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গতকাল ভোর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বান্দরবান। সাতকানিয়ায় বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন লক্ষাধিক মানুষ। বাঁশখালীতে পাহাড়ি ঢল ও বেড়িবাঁধ ভেঙে বঙ্গোপসাগরের পানিতে উপজেলার ৪২টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে এই এলাকার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. ওসমান গণি কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জেলার প্রতিটি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে টাকাও বিতরণ করা হবে।
চট্টগ্রাম নগরীতে গতকাল মুষলধারে বর্ষণে রাস্তায় বুকসমান পানি জমে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় সকালের দিকেই যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নতুন নতুন এলাকা জলমগ্ন হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। সকালে অফিসে যেতে এবং বিকেলে অফিস থেকে ফিরতে চরম দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী। আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গায় ৩৬২ দশমিক ৫ মিলিমিটার ও আমবাগানে ৪৩৬ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিতে মুরাদপুর ও বহদ্দারহাট এলাকায় পানি জমলেও গতকালের বৃষ্টিতে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় বুকসমান পানি জমে যায়। ২০০৭ সালের ১১ জুনের পর এবারই প্রথম এই এলাকায় জলাবদ্ধতা এমন প্রকট আকার ধারণ করে। এর ফলে বন্ধ হয়ে যায় সিডিএ এভিনিউ রোডের উভয় পাশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল। ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় মাত্র ৫৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই এই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সকাল ৯টার পর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ ষোলশহর থেকে মুরাদপুর হয়ে বহদ্দারহাট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ১০টা থেকেই সিডিএ এভিনিউ রোডের ষোলশহর ২ নম্বর গেট থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জলমগ্ন হওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে কালুরঘাট ও বহদ্দারহাট অংশের সঙ্গে আগ্রাবাদ ও পতেঙ্গা এলাকা এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাস্তায় জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ ছাড়াও ষোলশহর পুলিশ সুপারের কার্যালয়, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, শুলকবহর, কাতালগঞ্জ, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, কেবি আমান আলী রোড, ফুলতলা, বাকলিয়া, কাপাসগোলা, ঘাসিয়াপাড়া, ফরিদের পাড়া, খতিবেরহাট, চান্দগাঁও পাঠানিয়া গোদা সড়ক, হামিদচর, শমসেরপাড়া, আতুরার ডিপোর পূর্ব পাশের এলাকা, হাজীপাড়া, শহীদনগর, সুনি্নয়া মাদ্রাসার পাশের এলাকা, মোহাম্মদপুর, প্রবর্তক মোড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ওয়্যারলেস মোড়, জাকির হোসেন রোডের খুলশী রেলগেট, অলংকার মোড়, সাগরিকা মোড়, ছোটপুল, শান্তিবাগ, হালিশহর কে ব্লক ও এল ব্লক, চৌমুহনী নাজিরপুল, মোগলটুলী, পশ্চিম মাদারবাড়ী, ফিরিঙ্গীবাজার, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর, বন্দরটিলা, উত্তর পতেঙ্গা ও স্টিল মিল এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান উচ্চতায় পানি জমে গিয়ে ব্যাপক দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। এসব এলাকার নিচতলার বাসাগুলোতে পানি ঢুকে ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যায়।
সকাল ৯টা থেকে পানি জমে অনেক সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরিজীবীরা অফিসে যেতে বিড়ম্বনার শিকার হন। নগরীর হালিশহর নয়াবাজারের বাসিন্দা ও ব্যাংকার সাকিউল আলম ভূঁইয়া জানান, রাউজান নোয়াপাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শাখায় যাওয়ার জন্য বাসা থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় রওনা দিয়ে রিকশা, সিএনজি, বাসে এবং হেঁটে অফিসে পৌঁছান পৌনে ১২টায়। এই কর্মকর্তা সন্ধ্যা ৭টায় কালের কণ্ঠকে জানান, কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে সহকর্মীরা দল বেঁধে রওনা দেন। বিকেলে অফিস ছুটির পর থেকে যানবাহন না পেয়ে অনেকেই রাস্তার ওপর দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থেকে হেঁটে অথবা রিকশায় চড়ে কোনো রকমে বাসায় ফেরেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নগরীর জাকির হোসেন রোডে কখনো বৃষ্টির পানি না জমলেও গতকাল সকাল থেকেই ওয়্যারলেস মোড় ও খুলশী রেলগেট এলাকায় কোমরসমান পানি জমে যায়। নালাগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে পানি দ্রুত নামতে না পেরে সৃষ্টি হয় এই জলাবদ্ধতা। এ ছাড়া অনেক জায়গায় নালা ও খাল দখল করে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় পানি চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। একই কারণে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায়ও পানি জমে।
টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান বিজয় কুমার চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, নালা ও খালগুলো একই সময়ে এত বেশি পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারেনি বলেই জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আর সারা দিনে এক ঘণ্টার জন্যও বৃষ্টি বন্ধ হয়নি। বৃষ্টি বন্ধ না হওয়ায় সকাল ও বিকেলের জোয়ারের কারণেও পানি নামতে পারেনি। এ কারণে জলাবদ্ধতা দীর্ঘ রূপ নেয়।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রসঙ্গে পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শেখ হারুনুর রশিদ বলেন, ভারি বর্ষণের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে আরো কয়েক দিন এ ধরনের বর্ষণ হতে পারে। মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে এ বর্ষণ হচ্ছে।
ষোলশহরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের ভেতরে প্রায় দেড় ফুট পানি ওঠে। কার্যালয়ের বেশির ভাগ নথিপত্র দ্বিতীয় তলায় এবং টেবিলের ওপর তুলে রক্ষা করতে হয়েছে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. নাজমুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম কিছুটা বিঘি্নত হয়েছে। অফিসের নথিপত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে।
বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা : টানা বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার রবিউল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পানি জমে যাওয়ার কারণে রানওয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আটটি ফ্লাইট এবং অভ্যন্তরীণ সব বিমান চলাচল করেছে।' বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বিকেলে যখন বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়, তখনো ইমিগ্রেশন পুলিশ সৌদি আরবের জেদ্দাগামী একটি ফ্লাইটের যাত্রীদের ইমিগ্রেশন করছিল। বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়ার পর ওই যাত্রীদের আবাসিক হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত রাতে শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমান ও ফ্লাই দুবাই বিমানের শারজা, জেদ্দা ও ওমানের পথে পাঁচটি ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল।
জেটিতে ঢুকেছে মাত্র তিনটি জাহাজ : দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বহির্নোঙর থেকে সব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারেনি। গতকাল মাত্র তিনটি জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে। ভিড়েছে আরো তিনটি জাহাজ। ছয়টি জাহাজ জেটিতে প্রবেশ করতে পারেনি।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন এম শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাগর উত্তাল থাকায় গতকালও ভেতরে প্রবেশকারী জাহাজগুলোর সঙ্গে বন্দরের উদ্ধারকারী টাগবোট ছিল। এর পরও মাত্র তিনটি জাহাজ জেটিতে প্রবেশ করতে পেরেছে। অন্যগুলো সাগরে রয়েছে।'
কর্ণফুলী নদীর পানির উচ্চতা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় বন্দরে কনটেইনার জেটির পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক ছিল। তবে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাস সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। বহির্নোঙরে থাকা জাহাজ থেকে কোনো পণ্য খালাস হয়নি তিন দিন ধরে।
প্লাবিত ইপিজেডে ছুটি ঘোষণা : চট্টগ্রামের দুটি ইপিজেডে পানি ঢুকে পড়েছে। কর্ণফুলী ইপিজেডের বিভিন্ন জায়গা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে গেছে। ফলে সব কারখানায় বিকেল ৪টার দিকে ছুটি দেওয়া হয় বলে জানান কর্ণফুলী ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক খুরশিদ আলম। তিনি বলেন, 'কেইপিজেডে কখনোই এত পানি উঠতে দেখিনি। শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার স্বার্থে আমরা সব ফ্যাক্টরি ছুটি দিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। এখনো কোনো ফ্যাক্টরির ফ্লোরে পানি ঢোকেনি। তবে যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না।'
একই অবস্থা দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল চট্টগ্রাম ইপিজেডে। এই ইপিজেডের সব রাস্তা দুই থেকে আড়াই ফুট পানিতে ডুবে গেছে। অনেক কারখানা নির্ধারিত সময়ের একটু আগে ছুটি দিয়েছে বলে জানালেন এই ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক এস এম আবদুর রশিদ।
এদিকে কারখানাগুলো ছুটি দিয়ে দিলেও বাড়ি ফিরতে গিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে ইপিজেড শ্রমিকদের। প্রায় দুই লাখ শ্রমিক প্রায় একই সময়ে পানি ভেঙে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে রাস্তায় যান চলাচল এর আগেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অনেক কষ্টে হেঁটে ঘরে ফিরতে হয় তাদের।
রাতে আরেক দুর্ভোগ : বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার পর দুর্ঘটনা এড়াতে সন্ধ্যার পর নগরীর অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসসংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম পিডিবির সিনিয়র সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান রাত ৮টায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্রাহকরা ফোন করে বেশির ভাগ এলাকার বৈদ্যুতিক মিটার পানির নিচে ডুবে গেছে বলে জানানোর পর ঝুঁকি এড়াতে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।' এ ছাড়া নিচু এলাকাগুলোতে পানির কারণে গ্যাস সংযোগ নেই বলে স্থানীয় অনেক বাসিন্দা ফোন করে কালের কণ্ঠ অফিসকে জানান। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাত ৮টা ১৫ মিনিটে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামিল আহমেদ আলিমের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
এদিকে সন্ধ্যার পর নগরীর নিচু এলাকার বাসাবাড়িগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে। নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনার বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে দুটি গাড়ি তলিয়ে গেছে বলে জানান তাঁর স্ত্রী। এ ছাড়া উত্তর খুলশী ৩ নম্বর রোডে পুলিশের উপকমিশনার আবদুল্লাহিল বাকীর বাসার দেয়াল ধসে পড়েছে। নাসিরাবাদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানদেয়াল ভেঙে মোটরসাইকেল আরোহী এক ব্যক্তি চাপা পড়েন। এতে তিনি সামান্য আহত হন।
নগরীর আকবর শাহ মাজার এলাকায় একটি পাহাড়ের অংশবিশেষ ধসে পড়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় খবর আসে। তবে উদ্ধারকারী দল যানজটের কারণে রাত ৮টায়ও ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। দলনেতা চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'যানজটের কারণে জাকির হোসেন রোডের ওয়্যারলেস মোড়ে আটকা পড়েছি। তাই কিছু বলতে পারছি না।'
সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বান্দরবান
সোমবার রাতে ভারি বর্ষণ কমে যাওয়ায় বান্দরবান জেলা সদরের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও উজানে টানা বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় শঙ্খ নদ ও মাতামুহুরি নদী বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। রুমা, থানচি ও লামা উপজেলার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এদিকে সড়কের ওপর থেকে পানি কিছুটা সরে যাওয়ায় বান্দরবান-চট্টগ্রাম ও বান্দরবান-কক্সবাজার রুটে সোমবার রাতে আংশিক গাড়ি চলাচল শুরু হলেও গতকাল ভোর থেকে আবার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গতকাল বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, বান্দরবান-কেরানীরহাট অংশে বাজালিয়া আমতলী পয়েন্টে প্রায় দেড় শ মিটার সড়ক দুই ফুট পানির নিচে রয়েছে। এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে কিছু যানবাহন চলাচল করলেও কোচ-ট্রাকসহ বড় ধরনের সব গাড়ি চলাচল তৃতীয় দিনের মতো বন্ধ রয়েছে।
এদিকে বান্দরবান শহরের আর্মিপাড়া, মেম্বারপাড়া, মধ্যমপাড়া, উজানীপাড়া, শেরে বাংলানগর, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকার চার শতাধিক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে।
জেলা প্রশাসন, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ও বান্দরবান পৌর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আশ্রিত আড়াই হাজার মানুষকে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
লামা থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, গত তিন দিনের বৃষ্টিপাতে উপজেলা সদর ও পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যেকোনো সময় লামা বাজার ও উপজেলা কমপ্লেঙ্ এলাকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী।
আলীকদম উপজেলা সদরের নিচু এলাকা রেপার ফাঁড়ি, শিরাতলীপাড়া, সাবের মিয়াপাড়া, রোয়াম্ভু, নয়াপাড়া ও আমতলীপাড়ার বাসিন্দারাও রয়েছে গৃহহারা হওয়ার শঙ্কায়।
সাতকানিয়ায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি : কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন লক্ষাধিক মানুষ। শঙ্খ নদ ও ডলু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কের সাতকানিয়া অংশে একাধিক স্থান তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খ ও ডলু নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত দুই দিনে শঙ্খের ভাঙনে অর্ধশতাধিক বসতঘর বিলীন হয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাজালিয়ার পশ্চিম বাজালিয়া, বড়দোয়ারা, মাহালিয়া, ধর্মপুর, কালিয়াইশ, জনার কেওচিয়া, তেমুহনী, কেওচিয়া, উত্তর ঢেমশা, দক্ষিণ ঢেমশা, নলুয়া, মরফলা, আমিলাইশ, চরতি, সোনাকানিয়া, কাঞ্চনা, এওচিয়া, ছদাহা, পশ্চিম ঢেমশা, পৌর এলাকাসহ প্রায় পুরো সাতকানিয়া উপজেলা বন্যার পানিতে ভাসছে। এসব এলাকার তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
পরিবার-পরিজন ও গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে মানুষ বিপাকে পড়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় অনেক উপজেলা সদরের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারছে না। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে কয়েক কোটি টাকার মাছ।
চরতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম জানান, তাঁর ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ দুই দিন ধরে পানিবন্দি। নলুয়া ইউপির চেয়ারম্যান তসলিমা আকতার জানান, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় পুরো নলুয়া ইউনিয়নের মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বাজালিয়ার চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সিকদার জানান, চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কের সাতকানিয়া অংশে বড়দোয়ারা ও বায়তুল ইজ্জত এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় তিন দিন ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম শাহীন পারভেজ জানান, সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। বিষয়টি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে জানানোর পর বন্যাকবলিতদের জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ টন চাল ও দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাঁশখালীতে দুই লাখ লোক পানিবন্দি
টানা বর্ষণে পাহাড়ি ঢল এবং বঙ্গোপসাগরের বেড়িবাঁধ ভেঙে বাঁশখালী উপজেলার ৪২টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়া উপজেলার সঙ্গে বাঁশখালীর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। বানীগ্রাম, সাধনপুর এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখানে একাধিক মাটির ঘর ধসে পড়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উপজেলার পূর্ব এলাকার ১৫টি ছড়ার অতিরিক্ত পানি এবং বঙ্গোপসাগরের বেড়িবাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙনের ফলে এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাব্বির ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখনো পানি বাড়ছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যানরা বন্যা আক্রান্ত হওয়ার খবর দিচ্ছেন।'
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবান এবং সাতকানিয়া ও বাঁশখালী প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.