সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (এসএইউ)-সার্কে উচ্চশিক্ষা by শরিফুজ্জামান

‘দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (এসএইউ)। আমার মতে, সার্কের এযাবৎকালের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।’ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফোরকান আলীর মত এটি।


তিনি নয়াদিল্লির এসএইউতে সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করছেন।
ফোরকানের মতো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সার্কভুক্ত আট দেশের শিক্ষার্থীদের একেকজন দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের বসবাস, লেখাপড়া, মতবিনিময় অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
নেপালের শিক্ষার্থী হরি শর্মা কয়েকটি বাংলা শব্দ শিখেছেন। ভালো, খারাপ, সুন্দরসহ বেশ কিছু শব্দ তিনি বলতে পারেন। এসএইউয়ের ছাত্রাবাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে তিনি একই রুমে থাকেন। ঢাকা থেকে মুঠোফোনে নয়াদিল্লিতে যোগাযোগ করা হলে হরি শর্মা বলেন, ‘আমরা আট দেশের শিক্ষার্থীরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পারস্পরিক জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বিনিময় করে থাকি।’ তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আঞ্চলিক সমঝোতা তৈরি, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং এ অঞ্চলের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উৎসাহ জোগানোর কাজ শুরু করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট সার্কের বয়স এখন ২৮ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে নেওয়া অসংখ্য উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু সার্ক দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টিকে এযাবৎকালের সেরা উদ্যোগ বলেই মনে করছেন এ অঞ্চলের শিক্ষাবিদেরা।এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, মাত্র দুই বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সুনাম অর্জন হয়েছে, তা ঈর্ষণীয়। অচিরেই এটি বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নীত হবে, এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সার্কের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদার করতে অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (এসএইউ) বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখনো ওই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে ততটা সচেতন বলে মনে হয় না। এই সুযোগ কারও হাতছাড়া করা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।
নয়াদিল্লি থেকে ই-মেইলে পাঠানো বক্তব্যে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আইন পড়ানো হয়, তখন শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের আইন তাঁকে পড়তে হয়। আইন ছাড়াও ভাষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোযোগ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট। আইনের ওই শিক্ষার্থী আরও জানান, গত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বাংলা ভাষার জন্য লড়াই-সংগ্রাম ও ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের কথা অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। অন্য দেশের শিক্ষার্থীরাও তাদের জাতীয় দিবসে এমন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা আছে, তিনটি সুনির্দিষ্ট স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির পথচলা। প্রথমত, সমঝোতার সংস্কৃতি গঠনে আঞ্চলিক সচেতনতা তৈরি। দ্বিতীয়ত, মেধাবী ও মুক্তচিন্তার মানসম্মত নেতৃত্ব তৈরি। তৃতীয়ত, এ অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটানো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবক। ২০০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৩তম সার্ক সম্মেলনে দ্য সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন মনমোহন সিং। ২০০৭ সালের ৪ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সার্ক সম্মেলনে আটটি দেশের মধ্যে সার্ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চুক্তি সই হয়। আর ২০১০ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেশন শুরু হয় মাস্টার্স অব কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস এবং মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস খোলার মাধ্যমে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে আরও পাঁচটি বিষয় চালু হয়। এগুলো হচ্ছে এমএসসি (বায়োটেকনোলজি), এমএসসি (কম্পিউটার সায়েন্স), এমএসসি (সোসিওলজি), এমএসসি (ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস), মাস্টার অব ল (এলএলএম)। তৃতীয় সেশন শুরু হবে চলতি বছরের জুলাই থেকে। নয়াদিল্লির চাণক্যপুরিতে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ক্যাম্পাস। সাউথ দিল্লিতে ১০০ একর জমির ওপর নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নামকরা শিক্ষক, শিক্ষাবিদদের উচ্চ বেতনে জড়ো করা হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বৃত্তির সুবিধা। লেখাপড়া, থাকা-খাওয়ার খরচও তুলনামূলক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ১০০ মার্কিন ডলার, প্রত্যেক সেমিস্টারে টিউশন ফি ৪৪০ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ফেরতযোগ্য নিরাপত্তা জামানত ১০০ ডলার।
সুনির্দিষ্ট কোটা অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য কোটা ১০ শতাংশ করে। এ ছাড়া আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার জন্য বরাদ্দ চার শতাংশ কোটা। অন্যদিকে, ভারতের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়। সার্কভুক্ত আট দেশের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে, বাকি ১০ শতাংশ সার্কের বাইরের দেশ থেকে ভর্তি হবে। প্রত্যেক দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে মেধা তালিকা ঠিক করা হয়।
pintu.dhaka@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.