চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ৯ জনের মৃত্যু-বজ্রপাত ও পানিতে ডুবে বিভিন্নস্থানে নিহত আরো ১০

প্রবল বর্ষণে গতকাল মঙ্গলবার পাহাড় ও দেয়াল ধসে চট্টগ্রাম নগরীতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরো কয়েকজন মাটিচাপা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে বজ্রপাত ও পানিতে ডুবে কক্সবাজারে প্রাণহানি ঘটেছে সাতজনের।
ঢলের পানিতে ভেসে এক যুবক নিখোঁজ রয়েছে। সাতকানিয়ায় বজ্রপাতে দুই ভাইবোন ও সিলেটে পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ভারি বর্ষণে কক্সবাজারের সাতটি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিলীন হয়ে গেছে কক্সবাজার উপকূলের ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। চকরিয়া-পেকুয়া সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বরগুনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৫টি স্থান ভেঙে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার বিশ্বব্যাংক কলোনির পূর্ব পাশে হারবাতলী হাজিমারায় পাহাড় ধসে কয়েকটি কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়। উদ্ধারকর্মীরা গভীর রাতে ধ্বংসস্তূপ থেকে দুটি শিশুসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করে। তারা হলেন মো. খালেক (৬০), রাবেয়া বেগম (৪৫), রমজান আলী (২৮), মাসুম (১৮ মাস) ও কুলসুম (৮ বছর)। রাতে খুলশী থানার আকবর শাহ হাউজিং সোসাইটির ইয়াসিন কলোনির ওপর প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু একটি পাহাড় ধসে পড়লে আরো কয়েকটি ঘর মাটিচাপা পড়ে। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রথমে শাহানু নামে ১৬ বছরের এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। গভীর রাতের দিকে ঊমি নামে দেড় বছরের একটি শিশুর মৃতদেহ বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা। দক্ষিণ আমবাগান ফ্লোরাপাস রোডে দেয়াল ধসে একজন ও হাটহাজারীর চিকনদণ্ডি এলাকায় আরো একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একটি দল উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। রাত ১টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখার সময় উদ্ধারকাজ চলছিল।
কক্সবাজার থেকে আমাদের প্রতিবেদক জানান, বর্ষণ ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ার ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাতামুহুরী, বাঁকখালী, ঈদগাঁও ও সীমান্তের নাফ নদীর পানি ১০টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। উপকূলে ছয় দিন ধরে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকেই বজ্রপাতসহ ভারি বর্ষণ শুরু হয়। সকালে পাহাড়ধসে বাড়ির দেয়াল চাপা পড়ে সদর উপজেলার ঈদগাঁও দরগাহপাড়ায় মনোয়ারা বেগম (৫০) নামের এক গৃহবধূ মারা যান। তিনি স্থানীয় মুহাম্মদ ইসলামের স্ত্রী ও চার সন্তানের জননী। খুরুশকুলের কাউয়ারপাড়ায় মনজুরুল আলম ও পেকুয়ার ফাঁসিয়াখালীর সবজীবনপাড়ায় খালে মাছ ধরতে গিয়ে মুবিনুল ইসলাম (১৮) বজ্রপাতে প্রাণ হারান। এ ছাড়া প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড়ধসে ও পানিতে ডুবে গতকাল মহেশখালী দ্বীপে চারজন প্রাণ হারায়। এসব ঘটনায় আহত হয় কমপক্ষে পাঁচজন।
মহেশখালী দ্বীপের কালারমারছড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ ঝাপুয়া নামক স্থানে পাহাড়ধসে একটি বাড়ি চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান সখিনা বেগম (৪৫)। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী শফিউল আলম আহত হন। একই ইউনিয়নের উত্তর ঝাপুয়া গ্রামে পাহাড়ধসে দুটি ঘর চাপা পড়ে সাদ্দাম হোসেন (২৪) ও রাফি আকতার (১২) প্রাণ হারায়। এ ঘটনায় আহত হয় চারজন। অন্যদিকে দ্বীপের শাপলাপুর ইউনিয়নের জেএম ঘাট নামক স্থানে বিলের পানিতে ডুবে মারা গেছেন আবদুল মজিদ (৩৫) নামের এক ব্যক্তি। তিনি মৃগীরোগী ছিলেন বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানায়।
মহেশখালী থানার ওসি রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া দ্বীপে পাহাড়ধসে এসব হতাহতের ঘটনা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন। এদিকে পাহাড়ি ঢলে ঈদগাঁও নদী ও কালিরছড়া নদীতে চারজন ভেসে যায়। তাঁরা হলেন- কালিরছড়ার ট্যাঙ্চিালক জাফর আলম, মিজানুর রহমান, কৃষক আবু ছৈয়দ ও তাঁর শিশুসন্তান আবু আহমদ (৮)। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিকেলে তাঁদের মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু ঈদগাঁও নদীতে ভেসে যাওয়া মিজানুর রহমানের (২৮) খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি স্থানীয় গজালিয়া এলাকার ইসলামের ছেলে।
বৃষ্টি ও ঢলে টেকনাফ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও কক্সবাজার সদরে শত শত চিংড়ি ঘের ও ঘরবাড়ি পানিতে ভাসছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সাগরে যাচ্ছেন না বেশির ভাগ জেলে। মাছ ধরার ট্রলারগুলো নদীর তীরে নোঙর করে রাখা হয়েছে। কয়েক শ জেলে পরিবার অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
অন্যদিকে কক্সবাজারের টেকনাফের উপকূলীয় এলাকা শাহ পরীর দ্বীপ, মহেশখালী, ধলঘাট, মাতারবাড়ী, কুতুবদিয়া, পেকুয়ার মগনামা, কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল, ঈদগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। এসব এলাকায় বর্তমানে অবাধে জোয়ারভাটা চলছে।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় এখানে ১১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আরো কয়েক দিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
উখিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ : উখিয়া প্রতিনিধি জানান, সাত দিনের টানা বর্ষণে উখিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গ্রামীণ জনপদসহ শতাধিক বসতবাড়ি, ফসলিজমি, ক্ষেতখামার ও চিংড়িঘের তলিয়ে গেছে। ঝোড়ো হাওয়ায় গাছ উপড়ে পড়ে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে উপজেলার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, জনপদ প্লাবিত হওয়ায় স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাগামী ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানুষ উপজেলা সদর থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পালংখালী ইউনিয়নের দেড় শতাধিক চিংড়িঘের ভেসে গেছে। কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন ঘেরমালিকরা।
জালিয়াপালং ইউনিয়নের রেজু খালের দুই পাড়ের শতাধিক বসতবাড়ি তলিয়ে গেছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বর্ষণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া রাজাপালং ইউনিয়নের প্রত্যন্ত জনপদ দোছড়ি, মাছকারিয়া, মধুরছড়া ও শৈলরডেবা গ্রামে সাত-আটটি কাঁচাঘর ধসে পড়েছে।
গতকাল বিকেলে ভারি বর্ষণের পাশাপাশি প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়ায় মরিচ্যা লাল ব্রিজের উত্তর পাশে রাস্তার ওপর গাছ উপড়ে পড়লে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম জানান, যত দ্রুত সম্ভব গাছটি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে।
সিলেট অফিস জানায়, জৈন্তাপুরে বর্ষণজনিত বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল ১১টার দিকে উপজেলার সরুখাল গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শিশু রোপা বেগম (৭) ঘর থেকে বের হয়ে সবার অজ্ঞাতে পাশের বন্যার পানিতে পড়ে যায়। আধা ঘণ্টা পর বাড়ি থেকে ৫০ হাত দূরে শিশুটির লাশ ভেসে ওঠে।
সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বজ্রপাতে ভাইবোনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো আবু তাহের (১৪) ও মনি আকতার (১০)। গতকাল উপজেলার ছদাহা এলাকায় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এ সময় তাদের বাবা-মাও গুরুতর আহত হন। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিকেল ৫টার দিকে আবুল কাশেম স্ত্রী সুফিয়া খাতুন, ছেলে আবু তাহের ও মেয়ে মনি আকতারকে নিয়ে কাঁচাঘরের একটি কক্ষে বসে কাজ করছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে তাদের ঘর ভেঙে পড়ে এবং আবু তাহের ও মনি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আহত হন আবুল কাশেম ও সুফিয়া খাতুন। তাঁরা কেরানীহাটে আশ-শেফা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ আমবাগান এলাকায় দেয়াল চাপায় এক শিশু নিহত হয়েছে। জানা যায়, জনৈক ফারুকের বাড়ির দেয়াল ধসে কয়েকটি শিশু চাপা পড়ে। শিশুটির নাম আবুল হোসেন (৮), বাবা মো. শরিফ। এ ছাড়া হাটহাজারীতে গত রাতে বিবি কাওসার অ্যানি (১৫) নামে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী দেয়াল চাপায় প্রাণ হারায়।
বরগুনায় বাঁধের ১৫ স্থানে ভাঙন : বরগুনা প্রতিনিধি জানান, সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বরগুনার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ১৫টি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। বরগুনা সদর, তালতলী, বেতাগী, আমতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার কমপক্ষে ১৫টি স্থানের বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে অবাধে লোকালয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ওই সব এলাকার কয়েক হাজার বাসিন্দা।
জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বরগুনা সদর ছোট বালিয়াতলী এলাকার পায়রা নদী পাড়ের প্রায় আধা কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে নদীতে চলে গেছে। ফলে জোয়ারের পানি ঢুকে ছোট বালিয়াতলী, বড় বালিয়াতলী, রাখাইন পল্লী, ছোট তালতলী, মংকিসহ পাঁচটি গ্রামের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া তালতলী উপজেলার নলবুনিয়া এলাকার প্রায় দেড় কিলোমিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তেঁতুলবাড়িয়া, নলবুনিয়া, অংকুজানপাড়া, জয়ালভাঙা, আংগারপাড়া গ্রামের চার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমতলী উপজেলার ঘটখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, পাথরঘাটা এলাকার খলিফারহাট, জিনতলা, পদ্মা, তাফালবাড়িয়া, রূহিতা এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে এসব এলাকার ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের এবং বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ী এলাকায় পাউবো নির্মিত স্লুইসের সাইড পাইলিং ভেঙে ওই এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পাথরঘাটা, আমতলী ও বেতাগী পৌরশহর রক্ষা বাঁধ উপচে শহর প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বামনা লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে ওই সব এলাকার প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সাগরের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ঝোড়ো বাতাসের কারণে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পানি উন্নয়ন বোডের্র ৪১/৫ নম্বর পোল্ডারের বালিয়াতলী, ছোট বালিয়াতলী ও পাতাকাটা এলাকার দেড় কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। সিডরের পর ২৪টি পোল্ডারে বর্তমানে প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.