বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৩৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। তোফায়েল আহমেদ, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন রামগড়ে। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তাঁরা খবর পেলেন, রামগড় দখলের জন্য পাকিস্তানি সেনারা সেদিকে আসছে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবস্থান নেয় চিকনছড়ায়।


এই দলে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাতে হেঁয়াকো থেকে রামগড়ে আসতে না পারে। রামগড়-চিকনছড়া খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত।
৩০ এপ্রিল বেলা একটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী চিকনছড়ায় আক্রমণ করে। সেনারা বেশির ভাগ ছিল কমান্ডো। ঝোড়োগতিতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভেতরে ঢুকে ১০০ গজের মধ্যে এসে অতর্কিত আক্রমণ চালায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা তেমন সুবিধাজনক ছিল না। পরিখাগুলো (ট্রেঞ্চ) ছিল বেশ অপরিসর। শত্রুর উপস্থিতিও তাঁরা টের পাননি। ফলে অতর্কিত এই আক্রমণে তাঁরা বেশ বিপাকে পড়ে যান। তাঁদের পক্ষে পাকিস্তানি সেনা, বিশেষত কমান্ডোদের মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা ছিল বেপরোয়া প্রকৃতির।
আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন। এতে তাঁদের একাংশের মধ্যে যথেষ্ট ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ভীতসন্ত্রস্ত মুক্তিযোদ্ধারা অধিনায়ক ও প্লাটুন কমান্ডারের (উপদলের দলনেতা) নির্দেশ ছাড়াই পিছু হটতে থাকেন। এতে যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করছিলেন, তাঁরা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যান।
সেখানে এক প্রতিরক্ষা থেকে আরেক প্রতিরক্ষার মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। এ অবস্থায় প্রতিরোধরত মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকাদের দেখে মনে করেন যে অধিনায়ক বা প্লাটুন কমান্ডারের নির্দেশেই তাঁরা পিছু হটছেন। এরপর তাঁরাও পিছু হটতে উদ্যত হন। বেশ কয়েকজন পিছু হটেনও।
তোফায়েল আহমেদ এ সময় তাঁর দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিপুল বিক্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করছিলেন। একপর্যায়ে দেখা গেল যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর দল ছাড়া আর কেউ নেই বললেই চলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেপরোয়া আক্রমণে ক্রমশ তাঁদের অবস্থাও সংকটময় হয়ে পড়ে। তখন তাঁদেরও পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকল না।
সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে তোফায়েল আহমেদ বাধ্য হয়েই তাঁদের পিছু হটতে বললেন এবং তাঁদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য এ সময় তিনি নিজের জীবনের ওপর বিরাট এক ঝুঁকিও নেন। তিনি তাঁর অস্ত্র দিয়ে গুলি করে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখলেন। এই সুযোগে তাঁর সহযোদ্ধারা পিছু হটে যান।
শেষে তিনি একা। তখন তিনি গুলি বন্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য দূরে ঢিল ছুড়তে থাকলেন। পাকিস্তানিরা শব্দ লক্ষ্য করে গোলাগুলি করছে। তিনি পিছু হটছেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলেন না। হঠাৎ গোলার স্প্লিন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে গড়িয়ে পড়লেন পাহাড়ি ছড়ায়। এর পরের ঘটনা আরেক কাহিনি।
তোফায়েল আহমেদ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে বদলি হয়ে তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানিতে যোগ দেন। এর অবস্থান ছিল চট্টগ্রামে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনর্গঠিত হয়ে জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তোফায়েল আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৮৫।
তোফায়েল আহমদ ১৯৮১ সালে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। ২০০২ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার মিরপুর গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাস করতেন চট্টগ্রাম মহানগরের বায়েজীদ বোস্তামি এলাকায়। তাঁর বাবার নাম বসিরউল্লাহ খান, মা আরেফাতুন নেছা। স্ত্রী আয়েশা খাতুন। তাঁদের সাত মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: তাছলিমা বেগম (তোফায়েল আহমেদ বীর প্রতীকের মেয়ে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.