ন্যায্য মজুরি না দিলে শিল্প ও বাজার উভয়ই অনিশ্চিত হবে-পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি

সরকারিভাবে পোশাকশ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণই হলো বর্তমান সময়ের অন্যতম জ্বলন্ত প্রশ্ন। শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি দেওয়ার পক্ষে দেশব্যাপী জনমতও তৈরি হয়েছে। ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে এই মজুরি ঠিক করা নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারিভাবে গঠিত মালিক-শ্রমিক-সরকারের ত্রিপক্ষীয় কমিটি নবমবারের মতো সভায় বসেছে।


সরকারকে এ অবস্থায় যেমন মানবিক, যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত দিতে হবে, তেমনি মালিকপক্ষকেও শিল্পের স্বার্থেই অনড় অবস্থান ত্যাগ করতে হবে। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংসদে বলেছেন, ‘পোশাক শ্রমিকদের যে বেতন দেওয়া হয় তা শুধু অপ্রতুলই নয়, অমানবিক।’ আশা করি, মজুরি কমিশনের রোয়েদাদে তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটবে।
দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে লাভ ছাড়া আর সব কিছুই কম। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি কম, লাভজনক অরপ্তানিমুখী শিল্পের থেকেও কম, এমনকি দিনমজুরদের থেকেও কম! বর্তমানে মাসিক এক হাজার ৬২২ টাকার নিম্নতম মজুরি বিশ্বের মধ্যেও নিম্নতম। এমনকি নেপালের পোশাককর্মীরাও এর থেকে বেশি বেতন পান। কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকের মর্যাদাও এখানে অসন্তোষজনক। এরই প্রতিফলন ঘটে শ্রমিকদের লাগাতার অসন্তোষের মধ্যে। এখন পোশাকশিল্পের বিদেশি ক্রেতা ও অধিকার সংস্থাগুলোও অসন্তোষ জানাচ্ছে। বুধবারের প্রথম আলো বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বৃহত্তম ক্রেতা ওয়াল-মার্টসহ বিদেশি ক্রেতা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে সচেতন হচ্ছে। অন্যতম ক্রেতাদেশ নেদারল্যান্ডের ঢাকার দূতাবাস থেকেও এ ব্যাপারে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের মজুরি বাঁচার মতো অবস্থায় না এলে ভবিষ্যতে তাই একদিকে শ্রমিক আরও বিমুখ হবে, অন্যদিকে নিম্ন ভাবমূর্তির কারণে বাজার হারানোর আশঙ্কাও প্রবল।
গত বছরের তুলনায় এ বছর এই খাতের রপ্তানি ও আয় বেড়েছে। এ ছাড়া কম সুদের ঋণ-সুবিধা, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে কোটা-সুবিধাসহ বহুবিধ ছোট-বড় সুবিধা এ খাতের উদ্যোক্তারা পেয়ে থাকেন। এত কিছুর পরও কী কারণে এর সামান্য সুফল শ্রমিকেরা পাবেন না, তা বোধগম্য নয়। নিশ্চয়ই অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য উদ্যোক্তারা অভিনন্দন পাবেন। কিন্তু শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন তাঁদের কৃতিত্বকে যে ম্লান করে দিচ্ছে, তা বোঝার সময় এখন ঘনিয়ে এসেছে।
১৯৯৪ সালে পোশাকশিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয়েছিল ৯৩০ টাকা, ১২ বছর পর তা হয় এক হাজার ৬২২ টাকা। এই টাকায় বর্তমানে একজনের পক্ষেও বাঁচা কঠিন, সেখানে পরিবার নিয়ে বাঁচা কীভাবে সম্ভব? সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, মালিকপক্ষ সর্বোচ্চ দুই হাজার ২০০ টাকার বেশি দিতে চান না। অথচ অর্থনীতিবিদ ও পুষ্টিবিজ্ঞানীদের ভাষ্য হচ্ছে, আজকের বাজারে একজন শ্রমিককে প্রাণ ধারণ করতে হলে কমপক্ষে সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা প্রয়োজন। তার পরও শ্রমিক প্রতিনিধিরা নিম্নতম মজুরি হিসেবে মাসিক পাঁচ হাজার টাকার বেশি চাওয়ার সাহস করেননি। এখন মালিক-শ্রমিক উভয়ের মঙ্গলের স্বার্থেই পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি হিসেবে এই অঙ্ককে সাব্যস্ত করাই ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান।
এই সমাধানের দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। সরকারই এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী। সরকারের উচিত, পোশাকশিল্পের ভবিষ্যতের স্বার্থে এই শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বর্তমান বাজারদরে জীবনধারণের প্রয়োজন মেটানোর মতো করে ঠিক করা।

No comments

Powered by Blogger.