চরাচর-বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস by তামান্না ইসলাম অলি

'কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভেতরে সবার সমান রাঙা', অথবা 'জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি'_কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও যদি শুধু মানুষবাদে বিশ্বাস করতাম তবে আধুনিক বিশ্বে বর্ণবৈষম্য প্রতিরোধ নিয়ে এত সভা, সেমিনার, সম্মেলন করতে হতো না।
যদিও বর্ণবৈষম্য বলতে মোটা দাগে যা বোঝায় বাংলাদেশ তা থেকে অনেক দূরে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের গর্ব। কারণ, বিশ্বের বড় বড় দেশে এখনো স্পষ্ট বর্ণবৈষম্য রয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। সাধারণত বর্ণবৈষম্য বলতে বোঝায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। এই ভেদাভেদ হতে পারে সাদা আর কালোয়, আকারে, অথবা গোত্র-সম্প্রদায়ে। বর্ণবৈষম্যের কারণে নিজের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। আজ বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস। 'বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক হও : সমতা, দায়িত্বশীলতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করো'_এ স্লোগান সামনে রেখে ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস পালনের পেছনে রয়েছে এক রক্তঝরা ইতিহাস। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার অ-শ্বেতাঙ্গদের ভোটাধিকার ও ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ নিষেধাজ্ঞা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গরা। ২১ মার্চ ১৫ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ মিছিল বের করলে বর্ণবাদী সরকারের পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ৬৯ জন কৃষ্ণাঙ্গের। এ ঘটনায় আহত হয় আরো ১৪০ জন। আটক করা হয় ১০ হাজারের বেশি কৃষ্ণাঙ্গকে। পৃথিবীর বর্ণবাদী নির্যাতনের ইতিহাসের এ জঘন্য ঘটনাটি ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের কাছে শার্পারভিল এলাকায়। তখনো অবিসংবাদিত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা সাদা-কালো ভেদাভেদ মানতেন না। নিজেকে গণ-মানুষের রাজনীতিক ভাবতেন। কিন্তু এ মর্মান্তিক ঘটনার পর মোহভঙ্গ হয় তাঁর। তিনি দাঁড়ান নির্যাতিত কৃষ্ণাঙ্গদের পাশে। অবশ্য নিজে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা তাদের পাশে দাঁড়াননি, দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে। ১৯৬৪ সালে আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার তাঁকে আটক করে। দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান তিনি। তাঁর মুক্তির পর ২১ মার্চকে স্মরণে রাখার জন্য দিনটিকে আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আমরা বলতেই পারি, বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ বর্ণবৈষম্য মুক্ত। কিন্তু দেশ স্বাধীনের আগে পাকিস্তান সরকারের বাঙালিদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল তা মনে করে আজও শিউরে উঠতে হয়। পাকিস্তানিদের ওই বৈষম্যকেও আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য বলতে পারি। আমরা আমাদের জীবন দিয়েই বুঝতে পারি বর্ণবৈষম্য কত ভয়ংকর। তাই আজকের এই দিনে আমরা কামনা করি, গোটা পৃথিবী থেকে বর্ণবৈষম্য দূর হয়ে যাক চিরতরে। সবাই মিলে সাম্যের গান গাই_'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।'
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.