চারদিক-এক বংশীবাদকের গল্প by শারমিন নাহার

ঝড়-বৃষ্টি শেষে আকাশ তখন পরিষ্কার। আকাশে মিটিমিটি তারাগুলো জানান দেয় কালো মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে রাতের আকাশ। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। রাত তখন দুইটা। অর্ধচেতন অবস্থায় শুয়ে আছি বিছানায়। ঠিক সে সময় কানে এসে পৌঁছাল সুরেলা ধ্বনি।


বিছানা ছেড়ে উঠে ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায় খুঁজতে থাকি সুরের উৎস। চোখ চলে যায় হলের ঠিক বাইরে মূল ফটকের দিকে। সেখানে বসেই বাঁশি বাজাচ্ছেন এক বংশীবাদক। হলের ছাদ থেকে পড়া হ্যালোজেনের আলো এসে পড়েছে নারকেলগাছের পাতায়। হালকা বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে গাছের পাতা। আর এই পাতার ছায়া এসে পড়েছে বংশীবাদকের গায়ে। পাতার কাঁপন আর বাঁশির শব্দ যেন অন্য এক ঐক্যতানের সৃষ্টি করেছে। আর এই সুরের জাদুকরের নাম দুলাল মিয়া তুষারী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি বাঁশিওয়ালা মামা নামেই বেশি পরিচিত। হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মিতু বলেন, ‘হলে দুলাল নামে দুজন মামা থাকায় দুলাল মিয়াকে বাঁশি মামা নামেই ডাকি।’ দুলাল মিয়ার শখ বাঁশি বাজানো। রাত জেগে বাঁশি বাজান তিনি। তবে কাজ করেন হলের অফিস সহকারী হিসেবে। পাশাপাশি পালন করেন নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব। দুলাল মিয়া বলেন, ‘রাতের বেলায় জাইগা থাকলেও কখনো নিজেকে একা ভাবি না। রাতের শান্ত আকাশরে দেখি আর সঙ্গী হয় এই বাঁশি। মাঝে মাঝে অবশ্য গানও গাই।’
নবীন এবং অপেশাদার এই বংশীবাদকের বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালি থানায়। সংস্কৃতিমনা ও প্রকৃতিপ্রেমিক এই মানুষটিকে প্রশ্ন করি কীর্তনখোলার পারে ছোট্ট সেই শহর ছেড়ে কেন এই ইট-কাঠ-পাথরের খাঁচায়? দুলাল মিয়া ছন্দের তালে তালে বলেন, ‘আসলে গানই আমার কাল। আমি লুকায় লুকায় বাঁশি বাজাতাম, যাত্রা দেখতাম। বাপে এগুলি পছন্দ করত না। আমারে কিছু না কইয়া শুধু মারে সারা দিন গাইল পাড়ত। একদিন আমার জন্য মারে ধইরা পিডাইল। তারপর বাড়ি ছাড়লাম। তয় গান আর বাঁশি কিন্তু ছাড়ি নাই।’ কত দিন হলো বাড়ি ছেড়েছেন? তিনি বলেন, ‘হবে প্রায় ১৫ বছর।’ ঢাকায় এসে প্রথম কিছুদিন পত্রিকা বিক্রি করেছেন দুলাল মিয়া। এর অবশ্য অনেক পরে পেয়েছেন হলের চাকরিটা। তবে সব কিছুর পরও বাঁশি আর গান কিন্তু তিনি ছাড়েননি। কথার এক ফাঁকে বাঁশিওয়ালা মামা গান গেয়ে ওঠেন, ‘আমি এত ভালোবাসলাম যারে, সখী সে যদি ফাঁকি দেয় মোরে, কেমন করে থাকি।’
গান শেষ হতেই প্রশ্ন করি, মামা, কেউ কি ফাঁকি দিয়েছে আপনাকে? দুলাল মিয়া বলেন, ‘ফাঁকি তো সবাই সবাইরে দেয়।’ অনেকটা আপন মনেই কথাগুলো বলে উত্তরটা রহস্যের ঝুলিতে পুরে রাখেন তিনি। মূলত সামাজিক নানা অসংগতির চিত্র ফুটে ওঠে তাঁর গানের কথায়। তিনি বলেন, ‘নিজের মনের মতো গান বান্ধি, আবার সেগুলো বাঁশিতেও তুলি।’ শেখার কোনো শেষ নেই—এই বিশ্বাসকে পুঁজি করেই বেঁচে আছেন তিনি। দুলাল মিয়া বর্তমানে বাঁশি শিখছেন বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী গুরু আনন্দমোহনের কাছে।
হলের শিক্ষার্থী ঊর্মি বলেন, ‘এই ইট-পাথরের শহরে মামার বাঁশির সুর খুব উপভোগ করি। মামার বাঁশি শুনলে মনে হয় যেন গ্রামে ফিরে গেছি, সেই আমার চিরচেনা ছোট্ট গ্রাম।’ মামার বাঁশির সুর নাকি অনেক শিক্ষার্থীর মন ভালো করে দেয়। সত্যিই কি তাই? প্রশ্ন করতেই হেসে ওঠেন দুলাল মিয়া। হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমার বাঁশির একটু সুর কারও মন যদি ভালো করে দেয়, এই আনন্দের দাম তো লাখ টাকা।’ এমনি করে এগিয়ে চলে কথামালা। বাঁশি নিয়ে কোনো স্বপ্ন আছে কি না? দুলাল মিয়ার উত্তর, ‘তা তো আছেই। দিনে দিনে আরও ভালো করে বাঁশি বাজানো শিখতে চাই।’
গল্পের ঝাঁপিটা আটকে এবার উঠে দাঁড়ালাম বিদায় নেব বলে। বংশীবাদক দুলাল মিয়া হেসে বলেন, ‘আপা, একটু বসেন।’ পাশে রাখা বাঁশিটা তুলে নিয়ে সুর তোলেন তিনি। কান পেতে শুনি দুলাল মিয়ার বাঁশির সুর। হারিয়ে যাই অন্য এক জগতে...।

No comments

Powered by Blogger.