এই দিনে-সোহাগপুরের বিধবারা by আবদুল মান্নান

ছোট্ট একটি গ্রাম সোহাগপুর। সবুজ-শ্যামলিমা, পাখির কলকাকলি ভরা এই গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া নদী বুড়ি ভোগাই। দক্ষিণে গ্রামটিকে লতার মতো জড়িয়ে আছে আরেকটি নদী সুতিয়া। পশ্চিমে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে দুটি গ্রাম বেনুপাড়া ও রসাইতলা।


পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কালের সাক্ষী হয়ে আছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে কাকরকান্দি ইউনিয়নের নিভৃত পল্লি সোহাগপুর।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই এই দিনে গ্রামটিতেই ঘটে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদিন নৃশংসতার যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, তা কোনো দিন ভুলতে পারবে না সোহাগপুর। ভুলবে না বাংলাদেশ। সেদিনের সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ দিয়েছিলেন ১৮৭ জন নিরীহ লোক। একটি পাড়ার সব পুরুষকে মেরে ফেলা হয় বলে ওই গ্রামের নাম এখন বিধবাপাড়া। স্বজন হারানোর দুঃখবেদনার ক্ষত আর সেদিনের বিভীষিকা নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন ৩৪ জন বিধবা। বিজয়ের ৩৯ বছর পরও অভাব আর ক্ষুধা দূর হলো না এই গ্রামের গণহত্যার শিকার বিধবাপাড়ার সেই বিধবাদের। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। অবর্ণনীয় কষ্ট বুকে চেপে রেখে অনেকেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
গ্রামটিতে ঢুকেই কথা হলো বিধবা আকলিমা খাতুন (৭৫), সমলা বেগম (৭৫) ও দিনমণি রাকসামের (৭৯) সঙ্গে। তাঁরা জানালেন স্বামী-স্বজন হারানোর পর তাঁদের জীবনসংগ্রামের শুরু হওয়া কষ্টের কথা। কখনো রাস্তায় মাটি কেটে, কখনো অন্যের বাড়িতে ধান ভানার কাজ করে কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চলে। আস্তে আস্তে বয়স বাড়ে। কাজ করে জীবন চালানোর শক্তিও কমে যায়। সন্তানেরা বড় হয়। তাঁরাও বিয়েশাদি করে আলাদা সংসার গড়েন। এই বিধবারা আবার অসহায় হয়ে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই গ্রামের বিধবা নারীদের ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বিধবাদের মধ্যে দুটি করে ছাগল, রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে মাথাপিছু ২০ কেজি করে চাল, পাঁচ কেজি ডাল ও একটি করে শাড়ি দেন এবং ব্র্যাকের পক্ষ থেকে আমৃত্যু মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেন। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর অজ্ঞাত কারণে তাও বন্ধ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও শেরপুর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সোহাগপুর বিধবাপল্লি পুনর্বাসন প্রকল্প নামে কৃষি বনায়ন ও মাশরুম চাষসহ সমন্বিত আয়বর্ধনমূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ ছাড়া এলাকাবাসীর সহায়তায় এই গ্রামের শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ ও ৫৯টি গণকবর চিহ্নিত করে পাকা করার কাজ সম্পন্ন করা হয়। পুনর্বাসন প্রকল্পের আয় থেকে বিধবাদের ভাতার ব্যবস্থাসহ বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়া হয়। বিধবাপল্লি পুনর্বাসন প্রকল্প যেন টিকে থাকে, সে জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে সোহাগপুর বিধবাপল্লি পুনর্বাসন ট্রাস্ট গঠন করা হয়। প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর নতুন করে শহীদ পরিবারের বিধবাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
প্রকল্পটি নিয়ে তাঁদের মধ্যে স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকে। স্বামী-স্বজন হারানোর বেদনা ভুলে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই মুখ থুবড়ে পড়ে সোহাগপুর বিধবাপল্লি পুনর্বাসন ট্রাস্ট। বন্ধ হয়ে যায় বিধবাদের পুনর্বাসন ভাতাও। বর্তমানে ১০০ টাকা ভাতায় জীবনসংগ্রামে তাঁরা পরাজিত; তাই অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা বিধবাদের চোখেমুখে এখন রাজ্যের হতাশা। তাঁরা সরকারের সহযোগিতা চান। দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তা, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই যেন তাঁদের শেষ স্বপ্ন। তাদের পেছনে শূণ্যতা সামনে অন্ধকার।
স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে একটু স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান বিধবাপল্লির বিধবারা।

No comments

Powered by Blogger.