দিল্লির চিঠি-সহিষ্ণুতা ছাপিয়ে হিংসার বিস্তার by কুলদীপ নায়ার

ভারতে সহিংসতার ছড়াছড়িতে আমি ভীত। ক্রমশ এগুলো যে আকার নিচ্ছে, তা আরও ভয়ংকর। সহিংসতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক কারণে, আঞ্চলিক কারণে এবং আদর্শিক কারণেও। আইনের শাসনের ক্ষয় হচ্ছে এবং নিছক বলপ্রয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। ভেবেছিলাম, রাজনৈতিক দলগুলো আগুন জ্বালানো নয়, আগুন নেভানোর উপায় খুঁজে পাবে।


উল্টা কোনো কোনো দল তাদের ক্যাডারদের সংঘবদ্ধ করছে, তাদের কথামতো সংঘাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে অস্ত্র সজ্জিত করছে। হিন্দু জঙ্গিবাদীরাও এখন তৎপর।
মাওবাদীরা যতটাই বিপথগামী হোক না কেন, তারা তো অন্তত সরাসরি বলছে যে তারা ব্যালট বাক্সে বিশ্বাস করে না। তাদের ইতিহাস লেখা হয়েছে রক্তে। এক মাসের কিছু বেশি আগে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়া ও নারায়ণপুর জেলায় সেন্টাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের ১০০ জনেরও বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন। মাওবাদীদের ক্ষান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মিদনাপুর জেলায় তারা মুম্বাইগামী ট্রেনের ৭৬ জন যাত্রীকে মেরেছে। যে জনগণের মুক্তির কথা তারা বলে, তাদের হত্যা করে সেই লক্ষ্যে তারা কেমন করে পৌঁছাবে?
মাওবাদীদের কথা বাদ দিলাম, যারা নিজেদের সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাসী দাবি করে, তারাও স্বার্থে আঘাত লাগলে ততটাই নৃশংস হয়ে উঠেছে। হুরিয়াতের উসকানিতে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর পাথর নিক্ষেপের মতো ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। গত বছর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারবারই ঘটেছে।
কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়াবাড়ি ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক তদন্ত হওয়া উচিত। জঙ্গিবাদীদের প্রতি সরকারের জিরো টলারেন্স প্রদর্শনের অঙ্গীকারের মানে থাকে না যখন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নামে শিশুদের হত্যা করা হয়। জঙ্গিবাদীদের কাছে আমি কিছুই প্রত্যাশা করি না, কেননা তারা রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস করতে চায়, তাদের সাধ্যমতো গণতন্ত্র বিনষ্ট করতে চায়। সুতরাং নয়াদিল্লিকেই নিশ্চিত করতে হবে যেন রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী সন্ত্রাস না করে এবং অপরাধকারীর শাস্তি হয়।
সাম্প্রতিক কয়েক মাসে উত্তর ভারতে, বিশেষত হরিয়ানায়, পরিবারের সম্মান বাঁচানোর নামে বহু মানুষ হত্যার কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে এসব নৃশংসতা সরাসরি সমর্থন করছে খাপ পঞ্চায়েত। একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে করা কয়েকজন নারী-পুরুষ হত্যার শিকার হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন যুগলদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাব রাজ্যেও এমন ঘটনা ঘটছে। এমনকি ভারতীয় এক প্রবাসী ব্রাসেলসে তাঁর সৎমেয়েকে হত্যা করেছে, কারণ মেয়েটি নিম্নবর্ণের এক শিখ যুবককে বিয়ে করেছিল; বাবা তা মেনে নিতে পারেননি। এমন নৃশংসতা সামনে নিয়ে এসে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঠিক কাজই করেছে।
সহিংসতা ও সম্মান রক্ষার নামে হত্যাকাণ্ডকে অনেকে সমাজব্যবস্থার সঙ্গে একাকার করে দেখতে শুরু করেছে। তাই ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থার বদলে নৈরাশ্যবাদ ভর করছে। তারা দেখতে পাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা জুলুমবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রভাবশালীরা তাদের প্রতিপক্ষকে উচ্ছেদ এবং সমালোচকদের হয়রানি করতে সত্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছে।
একক দলীয় বা জোট সরকার, যেটিরই হোক না কেন, এসব পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। সবচেয়ে বাজে হলো, সরকারি চাকুরেরা। যেসব নৈতিক বিবেচনা তাদের কর্মের নির্দেশনা হিসেবে একসময় কাজ করত, তার কোনো বালাই আর নেই। এখন তাদের আচরণের একমাত্র প্রণোদনা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের স্বার্থ রক্ষা।
এসব দেখতে দেখতে জনগণের মোহমুক্তি ঘটেছে। ন্যায়বিচার সম্পর্কে তাদের ধারণা বদলে গেছে, তারা একে আপেক্ষিক বিষয় গন্য করছে। ভালোমন্দের ভেদবুদ্ধি তারা হারিয়ে ফেলেছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। কোনো বক্তৃতাবাগীশ বা কোনো সশস্ত্র ব্যক্তি নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে যদি এদের ব্যবহার করে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
ভারতে সহিংসতার ডাক দেওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক—এ কথা রাজনৈতিক দলগুলোর উপলব্ধি করা উচিত। এখানে নানা রকমের বিভক্তির প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। সংঘাতের ফলে প্রগতিশীল শক্তিগুলো সামাজিকভাবে লাভবান হবে, এই চিন্তা অবাস্তব।
আমার মনে পড়ে, আমি যখন যুক্তরাজ্যে ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার আমাকে বললেন, তিনি ভারতের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে মস্কোকে পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ আর ভাষার মানুষ ভারতে করছে, তবুও দেশটি শত শত বছর ধরে একীভূত রয়েছে।
ভারতের সফলতার কারণ কী, আমাকে জিজ্ঞাসা করেন থ্যাচার। তাঁকে বোঝাতে বেশ সময় লেগেছিল যে ভারতে কোনো কিছু শুধু সাদা আর কালো হিসেবে গণ্য করা হতো না; আমরা বিশ্বাস করতাম এক ধুসর এলাকার অস্তিত্বে, যা আমাদের বহুত্ববাদকে জোরালো করেছিল। ২০ বছর পর এখন আমার উপলব্ধি হলো, থ্যাচারকে আমি যা বলেছিলাম সে অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। তবে এ পরিবর্তন দেশের অনিষ্ট সাধনই করছে।
সহিষ্ণুতার চেতনা বা মানিয়ে চলার বোধ ভারতবাসীকে একতাবদ্ধ রাখার শক্তি যুগিয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তা আজ নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। যেসব দল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল্যবোধকে অস্বীকার বা পরাজিত করতে সচেষ্ট, তারা ভারতের ঐক্যের ক্ষতিসাধন করছে। এদের নিজস্ব এজেন্ডা আছে, এরা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হলেও সেই লক্ষ্য হাসিল করতে চায়। কর্মপদ্ধতিতে বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।
ভুল কর্মপদ্ধতি সঠিক ফল বয়ে আনে না—আমি এই মৌলিক নীতিবাক্যে বিশ্বাসী। এটা এখন আর কোনো নৈতিক মতবাদ নয়; বরং বাস্তবিক প্রস্তাবনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভারতও ভেঙে পড়তে পারে, যদি ভারতবাসী সংঘর্ষের বিপদ সম্পর্কে সচেতন না হয়। মাওবাদী, হুরিয়াত ও অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহিংসতা পরিহারই শুধু নয়, সহিংসতার ভাষা ব্যবহার থেকেও বিরত থাকা উচিত। সহিংসতার ভাষা ধীরে ধীরে বিভক্তি ও ঘৃণার সঞ্চার করে। বর্তমান পরিস্থিতি অনেক অনিশ্চিত—এ নিয়ে জনগণের সন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই।
গালফ নিউজ থেকে নেওয়া; ইংরেজি থেকে অনুবাদ আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.