নিমতলী ট্র্যাজেডির দুই বছর-তবু বেঁচে থাকা by শেখ সাবিহা আলম

‘মরহুম বৈশাখ। ৩ জুন ২০১০-এর নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে আমার চোখের সামনে আব্বু ডাক দিয়ে চিরতরে চলে গেল আমার আদরের ছেলে বৈশাখ (৭)। তাকে বাঁচাতে পারিনি হিংস্র লেলিহান আগুন থেকে। কী যে বুকভরা কষ্ট নিয়ে, আজও এই স্মৃতিমাখা বেদনা সঙ্গে নিয়ে, এই ছোট্ট দোকানে তার সকল স্মৃতি নিয়ে ফলের দোকান করছি হতদরিদ্র, হতভাগা বাবা!’


প্রমিত বাংলায় মনের ভাবটুকু প্রকাশ করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই ফলের দোকানি মো. মামুনের। অগ্নিকাণ্ডে ছেলে হারিয়েছেন, হারিয়েছেন ব্যবসার পুঁজিও। কিন্তু সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এখনো অম্লান। চোখের সামনে সন্তানকে হারানোর ব্যথার কাছে হার মেনেছে সব প্রতিবন্ধকতা। তিনি দোকান বন্ধ রেখে ছেলে বৈশাখের ছবিসহ ব্যানার টানিয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে।
গতকাল শনিবার মো. মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সাথেই দোকানে বইসা আছিল ও, আম খাইতেছিল। হঠাৎ মনে হইলো, ট্রান্সফরমার ফুটছে। তারপর শুধু একটা চিক্কুর, “আব্বু”। চোখের সামনে দেখি, আমার এত্তবড় পোলাটা ছুট্টু হইয়া গেছে, পুইড়া কয়লা। ওরে ধরমু কী! দেখি, আমার শরীর থাইক্যা গোস্ত গইলা গইলা পড়তাছে।’
মামুনের মুখের কথা কেড়ে নেন মো. রিপন। মুঠোফোনে থাকা বোন লাভলী বেগম আর ১০ মাস বয়সী ভাগনে রাবীবের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে দেখেন, এই আমার ভাইগনা। আমার জানের চেয়ে প্রিয় আছিল সে।’ মামুন কাঁদেন। রিপন কাঁদেন। কিন্তু কে কাকে সান্ত্বনা দেবে, সবাই তো স্বজনহারা। সবার চোখে পানি। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। ৪৩/এ নবাব কাটরায় হাজি মো. গুলজারের যে বাড়ি থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেই বাড়ির ১১ জন নেই। মো. রিপনের বাড়ির ছয়জন নেই, শরিফউদ্দিন দুলালের বাড়ির পাঁচজন নেই। এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে পরিবারের সবাই বেঁচে আছেন।
এত প্রাণহানি, এত ক্ষয়ক্ষতি, এত কান্না আর আহাজারির পরও নিমতলী রয়ে গেছে আগের মতোই। যে বাড়ি থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেই পাঁচতলা ভবনে চুনকাম হয়েছে। বাড়ির সামনে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ হয়েছে। তার দেয়ালে লেখা, ‘আমরা সচেতন’। কিন্তু এই সচেতনতা নিয়ে নানা প্রশ্ন এলাকাবাসীর। এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাসায়নিকের গুদাম। রাসায়নিকের এই গুদাম থেকেই সূত্রপাত হয়েছিল নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো. জাভেদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পরপর সরকারি নানা দপ্তরের মধ্যে তোড়জোড় দেখা গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ঘন ঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানও পরিচালনা করেছেন। এখন আর কোনো তৎপরতা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অগ্নিকাণ্ডের পরপর একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। তারা দেখতে পায়, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীতে ৯৯৪টি রাসায়নিকের গুদাম আছে, এর মধ্যে ১২৭টির অনুমোদন আছে। ওই টাস্কফোর্স বৈধ-অবৈধ সব ধরনের কারখানাই অপসারণের প্রস্তাব করেছিল। কথা ছিল, একটি কমিটি রাসায়নিক ব্যবসার বিধিবিধান ও দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের তালিকা তৈরি করবে। একই সঙ্গে গুদামজাত, পাইকারি ও খুচরা শিল্পে ব্যবহারের জন্য কী পরিমাণ কাঁচামাল সংরক্ষণ করা যাবে, তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করবে। অপর কমিটি আগস্ট ২০১১-এর মধ্যে কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ অথবা ঢাকার আশপাশে জায়গা খুঁজে বের করবে। কিন্তু কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুতার কারখানা, প্লাস্টিকের কারখানা, পলিথিনের কারখানা—কী নাই? যারা এসব কারখানা চালায়, তারা তো এই এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী। আমরা এলাকাবাসী কিছু কইলেই মামলার ভয় দেখায়। প্যাডে ভাত জোগামু, না মামলা লড়মু?’
তবু বেঁচে থাকা: গত দুই বছরে নিমতলীতে জন্ম নিয়েছে বেশ কটি নতুন শিশু। বাবা-মায়েরা তাঁদের এসব সন্তানের মাঝেই খুঁজে পেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখগুলো। উম্মে ফারওয়া আক্তার, প্রধানমন্ত্রীর তিন কন্যার একজন, এখন এক সন্তানের মা। ছেলের নাম সৈয়দ আলী মুর্ত্তাজা আজান। হোসেনি দালান শিয়া মসজিদের গলিতে ফারওয়ার স্বামী রাশেদ হোসেন বললেন, ‘দেখেন না, আমার ছেলের গায়ের রং একদম আমার মায়ের মতো।’ গুলজার হোসেন তাঁর এক বছরের ছেলের নাম রেখেছেন ইমতিয়াজ গুলজার। অগ্নিকাণ্ডে নিহত যমজ দুই সন্তানের একটির নাম ছিল ইমতিয়াজ। ফলের দোকানি মো. মামুন ছেলের নাম রেখেছেন ‘শ্রাবণ’। উজ্জ্বল চোখে জানালেন, দেখতে ছেলেটি অবিকল বৈশাখের মতো।

No comments

Powered by Blogger.