সাদাকালো-পতিসরে অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটাতে হবে by আহমদ রফিক

তিহ্য-নিদর্শনাদি নিয়ে আমাদের সমস্যা যেন শেষ হওয়ার নয়। মনে হয় আমরা দিন দিন ঐতিহ্য বিনাশী হয়ে উঠছি। ঢাকায় করোনেশন পার্ক, বড়কাটরা, ছোটকাটরা বা শঙ্খনিধি হাউস থেকে উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক নিদর্শন 'ভীমের জাঙ্গাল' (উঁচু প্রশস্ত বাঁধ) সবকিছু এক এক করে বৈনাশিক আক্রমণের শিকার। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের পতিসর, তাও যখন কবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে।


তবে পতিসর কুঠিবাড়ী সরাসরি আক্রমণের মুখে নয়, বলা চলে অবরোধের মুখে। বলা যায় পরিবেশ বিনাশ।
পতিসর কুঠিবাড়ীসংলগ্ন অনেকখানি জায়গা কাছারিবাড়ির অন্তর্ভুক্তই ছিল। আমাদের চেষ্টায় কুঠিবাড়ী অধিগ্রহণের সময় সম্ভবত স্থাপত্য-নিদর্শন হিসেবে শুধু কুঠিবাড়ীটিই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এখতিয়ারে আনা হয়। কিন্তু আমাদের (রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের) চিঠিতে সম্পূর্ণ জায়গাটি (সামনের মাঠসহ নাগর নদীর পাড় পর্যন্ত) কুঠিবাড়ীসংলগ্ন এলাকা হিসেবে সরকারের অধীনে আনার কথা ছিল। যে কারণেই হোক তা হয়নি। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের অধিকারভুক্ত বাকি জায়গা খাস সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের না হলেও সরকারের তো বটেই।
কয় দিন ধরে একাধিক দৈনিকপত্রে (যেমন প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, সমকাল, যুগান্তর, যায়যায়দিন ইত্যাদিতে) পতিসর বিষয়ক খবর প্রকাশিত হয়েছে। মূল অভিযোগ কুঠিবাড়ীর সামনে বাজার বসানো এবং সংলগ্ন খাসজমি দখলের চেষ্টা, কুঠিবাড়ী ঘিরে অনাচার ইত্যাদি নিয়ে। সংবাদের শিরোনাম 'রবিঠাকুরের বাড়ি ঘিরে বাজার' 'পতিসরে বিশ্বকবির কাছারিবাড়ির সামনের জায়গা দখলের চেষ্টা (বসানো হয়েছে হাট, ভরাট করা হয়েছে নদীর ঘাট)', 'পতিসর রবীন্দ্র মিউজিয়ামের বারান্দায় হাট/পুরো এলাকা অবৈধ দখলদারদের হাতে' ইত্যাদি।
পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে প্রকাশ 'কাছারিবাড়ির (জাদুঘর) বারান্দা ও সামনের ফাঁকা স্থানে হাটবাজার বসছে। বাড়ির আশপাশ ঘিরেও গড়ে উঠছে অসংখ্য দোকান। এতে ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সৌন্দর্য হারানোর পাশাপাশি ধ্বংসের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।... 'জাদুঘরের প্রধান ফটকের সামনের জায়গায় বসেছে কাঁচামালের দোকান। বারান্দায় বসেছে চাল ও মাছের আড়ত। রবীন্দ্র ভাস্কর্যের চারদিক ঘিরে কাঁচাবাজার।' রবীন্দ্রদীঘির 'পশ্চিমাংস ছেয়ে গেছে দোকানপাটে। জাদুঘরের দক্ষিণে রয়েছে একটি মাঠ, যার পূর্বদিকজুড়ে গড়ে উঠেছে সারি সারি দোকান।' (প্রথম আলো, ১৫.১.২০১১)
একই রকম প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে 'দৈনিক সমকাল'-এ (১৪.১.২০১২)। সেই সঙ্গে মন্তব্য "দোকানঘর নির্মাণের মাধ্যমে দখল করা হয়েছে কাছারিবাড়ির পূর্বদিকে 'রবীন্দ্রদীঘি' নামে পরিচিত দৃষ্টিনন্দন সেই জলাধারের পাড়ও। হাটবাজারের নামে চারদিকে জায়গাজমি দখলের কারণে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন ওই কাছারিবাড়ির প্রবেশপথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।" আরো কয়েকটি কাগজে ছাপা হয়েছে অনুরূপ বিবরণ। তাই ধরে নেওয়া যায় অভিযোগগুলো সঠিক। দিন কয়েক আগে পতিসর থেকে স্থানীয় রবীন্দ্র নিদর্শনাদির সংগ্রাহক মতিউর রহমান মামুন টেলিফোনে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানান এবং এসব অনাচারের আশু প্রতিকার দাবি করেন।
আমরা জানি, রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত পতিসর রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব জমিদারি (ভাগবাটোয়ারার পর) কালিগ্রাম পরগণার সদর কাছারি। এখানে তৈরি কুঠিবাড়ী রবীন্দ্রনাথের জমিদারিসংক্রান্ত কাজকর্মের সেই সঙ্গে তাঁর গ্রামোন্নয়ন ও পল্লী পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। যখনই কবি পতিসরে এসেছেন বাস করেছেন এই কুঠিবাড়ীতে, কখনো নাগর নদীতে বোটে। উঁচুপাড় নাগর নদী নিয়ে লিখেছেন 'আমাদের ছোটো নদী' কবিতা, কুঠিবাড়ীর সামনে প্রশস্ত মাঠে ছিল বাগান, পূর্বদিকে তালগাছের সমাহার। তাই দেখে 'তালগাছ' কবিতা। আর 'ছিন্নপত্রাবলী'তে বাঁক ফেরা নাগর নদী সম্পর্কে প্রশস্তি।
এ ছাড়া কুঠিবাড়ীটিকে কেন্দ্র করে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল মাঠ, দিঘি, সরোবর, কর্মচারীদের থাকার উপযোগী ছোট ছোট পাকা বাড়ি, ছিল চিকিৎসা কেন্দ্র। সে সবের কিছু আছে, অনেক কিছুই নেই। লুটেরা ও ভূমিদস্যুদের লোভে বিশ্বজুড়েই নষ্ট হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন। পতিসর, সাজাদপুর, শিলাইদহ ব্যতিক্রম নয়। পতিসর সম্পর্কে আমাদের বিশেষ আগ্রহের কারণ এখানেই রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নানা স্তরের শিক্ষায়তন, কিংবদন্তির কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক (১৯০৫ সালে)। যে ব্যাংক গরিব প্রজাদের সহজ সুদে ঋণ দিয়ে তাদের মহাজনের ঋণমুক্ত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। সেই ঋণ প্রথাই এ কালে 'ক্ষুদ্রঋণ সহায়ক ব্যবস্থা' বা 'মাইক্রোক্রেডিট সিস্টেম' নামে বিশ্বজুড়ে বহুল প্রশংসিত। এমনকি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণদান সুবাদে নোবেল পুরস্কার এসেছে আমাদের ঘরে।
এমন সব কারণে রবীন্দ্রস্মৃতিজড়িত পতিসর এখন বাংলাদেশের রবীন্দ্রানুরাগীদের নজরকাড়া উল্লেখযোগ্য স্থান, যা জাতীয় পর্যায়ে গর্বের ও আনন্দের। সেই পতিসরের নিদর্শন, স্থাপনাদি ও জায়গা যথাযথভাবে সংরক্ষণ আমাদের জাতীয় কর্তব্য, তা সেসব স্থাপনা ও জায়গাজমি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বা সরকারি প্রশাসন যাদের অধীনেই থাকুক। কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছি কুঠিবাড়ীর কাছাকাছি অবস্থিত 'রবীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন' নামক হাই স্কুলের ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়ালবিশিষ্ট কয়েকটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে নতুন করে নির্মাণের তাগিদে।
তবে পত্রিকাগুলোর সচিত্র প্রতিবেদন পড়ে এবং মতিউর রহমান মামুনের বিবরণ শুনে এবারকার জবরদখলের পরিস্থিতি মনে হয় ভয়াবহ ও অকল্পনীয়। বেশ কিছুকাল থেকে দেখে আসছি বাংলাদেশে একশ্রেণীর মানুষ লোভের-লাভের টানে জবরদখলের জমজমাট হাট বসিয়েছে। সরকারের সাধ্য কি তাদের রোখা? কিন্তু সমাজে নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে ওদের রুখতে হবেই। এ বিষয়ে সরকারি প্রশাসন বা সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠিন হতেই হবে।
পতিসরের বিবরণ থেকে বোধ হচ্ছে, সেই লোভের হাত এবার প্রসারিত হয়েছে রবীন্দ্রঐতিহ্যের দিকে। আজকের দুর্মূল্যবাজারে এত জায়গা, খোলা মাঠ মুক্ত রাখা যায়? অবৈধ দখলের মাধ্যমে ওই সব মুক্ত মাঠঘাট, দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে ভরে তুলতে হবে। হোকনা সেসব সরকারি সম্পত্তি। রবীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন দেখতে গিয়ে দুই দশকেরও আগে এমন তথ্য পেয়েছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ ওই স্কুল ভালোভাবে চলার জন্য স্কুলের নামে ২০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন।
কথা প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধান স্কুলশিক্ষক অসহায় কণ্ঠে বলেছিলেন, বেশ কিছু পরিমাণ জমি বেহাত হয়ে গেছে। ওগুলোর পুনরুদ্ধার অসম্ভব বললেই চলে। এ বিষয়ে মামুন রাজস্ব অফিস থেকে দাগ-খতিয়ান সংবলিত কাগজপত্র তুলেছেন, যাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মালিকানা প্রমাণিত। স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে আন্তরিক হলে বেহাত হওয়া জমি উদ্ধার সম্ভব।
একই ভাবে প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সক্রিয় হলে পতিসরের কুঠিবাড়ীসংলগ্ন স্থানের অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটানো সম্ভব হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে পতিসর কুঠিবাড়ী এখানো ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান। বিদেশি পর্যটক এখনো রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত এসব স্থান দেখতে আসেন। এই কিছুদিন আগে কানাডার দুই গবেষক-অধ্যাপক পতিসর ও সাজাদপুর গিয়েছিলেন সবকিছু ঘুরে দেখতে। বর্তমান অবস্থা বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হবে। আর আমাদের জন্য লজ্জার।
স্বভাতেই স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের আহ্বান পর্যটন সম্ভাবনাময় পতিসরে কুঠিবাড়ী ও সংলগ্ন এলাকা অবৈদ দখলদারিরর হাত থেকে মুক্ত করে পর্যটন-উপযোগী ও সংস্কৃতি অনুরাগী মানুষের যাতায়াতযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলায় সহায়তা করুন। ঐতিহ্যের দূষিত পরিবেশ যে জাতির জন্য লজ্জাজনক সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অবিলম্বে স্মৃতিময় পতিসরকে ঐতিহ্যিক বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা করতে রবীন্দ্রানুরাগী স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রতিও অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে এমন ব্যাপকভাবে রবীন্দ্র স্মৃতিসংলগ্ন জায়গায় অবৈধ অনুপ্রবেশ কিভাবে সম্ভব হলো? আর স্থানীয় প্রশাসনও এ বিষয়ে কেন নীরবতা পালন করে চলেছে।
যতদূর জানি স্থানীয় জেলা প্রশাসক সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী এলাকা জঞ্জালমুক্ত করার কাজে অবিলম্বে তৎপর হতে তাকেও ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। শক্ত হাতে এসব সামাজিক দুর্নীতি দমন না করলেই নয়। যতদূর মনে পড়ে অতীতেও একবার এখানে অবৈধ বাড়িঘর, দোকানপাটের ব্যবসা শুরু হয়েছিল, যা তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দূর হয়েছিল।
এবারও তেমন ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষয়টা দুর্ভাগ্যজনক যে যখন এ বছর সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে, তখন 'রবিতীর্থ' নামে পরিচিত পতিসরে ন্যক্কারজনক অনুপ্রবেশ! এর পেছনে নিশ্চয়ই শক্তিশালী কোনো মহলের হাত রয়েছে। প্রশাসনকে তা খুঁজে বের করতে হবে।
'সমকাল' পত্রিকায় (১৪ জানুয়ারি, ২০১২) এ বিষয়ে মতিউর রহমান মামুনের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে 'সাত-আট মাস আগে হঠাৎ করে কাছারিবাড়ির সামনে বাঁশ ও টিন দিয়ে দোকানঘর তোলা শুরু হয়।' আমাদের প্রশ্ন, প্রশাসনের চোখের সামনে দীর্ঘসময় ধরে এ ধরনের অবৈধ দখলদারি কিভাবে সম্ভব? এত বড় ঘটনা 'রবীন্দ্রচেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ' নামক স্থানীয় সংগঠনের চোখে পড়েনি? তাদের দায়িত্ব ছিল এ বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করা।
সে যাই হোক, যা ঘটে গেছে তার তো চারা নেই। এখন গোটা বিষয় যখন ব্যাপকভাবে সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত, সে সূত্রেই স্থানীয় প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কঠোর হাতে কুঠিবাড়ী এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেবে_এমনটা আমাদের সবার প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে তদন্ত করা দরকার কেন, কিভাবে, কাদের শক্তি বা সহায়তায় অবৈধ দখলদারি সম্ভব হলো এবং দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা যায়। আশা করি, প্রশাসন এ দায়িত্ব পালনে অবিলম্বে তৎপর হবে।

লেখক : ভাষা সংগ্রামী, কবি, রবীন্দ্র গবেষক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.