গোপালগঞ্জ-১ : মুকসুদপুর-কাশিয়ানী-আ. লীগ চলে মন্ত্রীর কথায়

"মরা যখন রাজনীতিতে আসি, তখন কেন্দ্রীয় নেতা বা বড় কোনো নেতার কথা শুনে দল করতাম না। আমরা যারা দল, করতাম নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বাবার হোটেলে খেয়ে রাজনীতি করেছি। বর্তমানে মুকসুদপুরে কোনো রাজনীতি নেই। এমপি ফারুক খান এবার দিয়ে তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এমপির কিছু লোক আছে। তারা যেভাবে চালাচ্ছে, সেভাবেই চলছে।


বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিকুর রহমান মিয়া, সাধারণ সম্পাদক শাহ আকরাম হোসেন জাফর এবং উপজেলা চেয়ারম্যান রবিউল আলম শিকদারসহ সাত-আটজন লোক আছেন। তাঁরাই মন্ত্রীকে চালান এবং সংসদীয় আসনের রাজনীতি দেখাশোনা করেন। যেসব লোক জাতীয় পার্টি করেছে, বিএনপি করেছে, ধানের শীষে ইলেকশন করেছে, তিন-তিনবার দল পাল্টিয়েছে, তারপর তাঁকে সভাপতি বানিয়েছে। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান তো বিএনপির লোক। চেয়ারম্যান হওয়ার ছয় মাস আগেও তো বিএনপি করেছেন। তার আগে জাতীয় পার্টি করেছেন। প্রথমে ছাত্রলীগ করেছেন। তাঁরা এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা। এমপির স্থানীয় যেসব নেতা-কর্মী আছেন, তাঁরা এসব প্রার্থীর কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুযোগ নিয়েছে। তাঁরা গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। যাদের মাঠে এক বিঘা জমি ছিল না, তাদের ঢাকায় ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। যেসব প্রার্থীকে ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনি মনোনয়ন দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই পরাজিত হয়েছেন। ফারুক খান তো আওয়ামী লীগ ধারার লোক নন। এলাকায় তাঁর কোনো জনপ্রিয়তা নেই। আওয়ামী লীগের নৌকা ছাড়া তিনি যদি ইলেকশন করেন, তাহলে একটি ওয়ার্ডের মেম্বারও হতে পারবেন না। আমাদের মুকসুদপুরের মানুষ তো শেখ মুজিবুর রহমানের নৌকার অন্ধ ভক্ত। তাই নৌকায় ভোট দেয়, ব্যক্তি ফারুককে ভোট দেয় না। আমাদের মুকসুদপুরে প্র্যাকটিক্যালি কোনো গ্রুপ নেই। বেশির ভাগ নেতা-কর্মী অসন্তুষ্ট। যাঁরা আগে নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা বর্তমানে রাজনীতি থেকে দূরে। যাঁরা ত্যাগী নেতা, তাঁরা বলেন, আগামীতে আর ফারুক খানকে ভোট দেব না। যখন ইলেকশন আসে, তখন শত কষ্ট হলেও ঘুরেফিরে ভোট নৌকায়ই দেন। বলেন, 'মুজিবরের মাইয়া একখান নৌকা পাঠাইছে, তোরা নৌকা খানরে ভইরা দে'।"_কথাগুলো বলেছেন মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মুন্সী মো. আতিয়ার রহমান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, 'মন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের টিআর-কাবিখা নেতা-কর্মীরা ভাগ করে নেন। দলের বিভিন্ন ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডেকে তাঁদের চাহিদামাফিক তালিকা করা হয়। তালিকা করে মন্ত্রীকে জানালে তিনি হ্যাঁ বললে আমরা ফাইনাল করি।' আর সরকারি যে বরাদ্দ, তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ভাগ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'নতুন বছরে কাবিখা ১০ টন এবং টিআর ১০ টন এসেছে। গত সোমবার ভাগাভাগি হয়েছে। যাঁরা মন্ত্রীর কাছের চেয়ারম্যান, তাঁরা তো একটু ভাগ বেশি পাবেনই। এটাই স্বাভাবিক।'
মুকসুদপুর উপজেলার ১৬টি এবং কাশিয়ানী উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গোপালগঞ্জ-১ আসন গঠিত। এলাকার রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্যের দল আওয়ামী লীগ। এলাকাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। শিকড় পর্যায়ে রয়েছে দলের সাংগঠনিক কাঠামো। কিন্তু কাঠামোতে এখন ঘুণ ধরতে শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা আওয়ামী পরিবারের লোক মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে না থাকায় দলের নেতা-কর্মীরা হতাশা হয়ে পড়েছেন। বর্তমান মুকসুদপুর আওয়ামী লীগে নেই কোনো গণতন্ত্র। যাঁরা দলকে সংগঠিত করে এলাকায় বঙ্গবন্ধুর নৌকাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেসব নেতা-কর্মীর কোনো মূল্যায়ন নেই বর্তমানে।
গোপালগঞ্জ-১ আসন প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের দখলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন কাজী আবদুর রশীদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে আসনটি ছিনিয়ে নেন বর্তমান এমপি ফারুক খান। কাজী আবদুর রশীদ বলেন, 'সে আমার পুরনো এবং পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কমিটি গঠন করেছে। তাই ত্যাগী এসব নেতা-কর্মী এখন আর দল না করে ঘরে বসে থাকে। অনেক কষ্ট করে দলকে সংগঠিত করেছি। আমার সময় দলে একটা গণতন্ত্র ছিল। এভাবে একটি গণতান্ত্রিক দল চলতে পারে না। এখনো সময় আছে সঠিক কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নেওয়ার।'
মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সদস্য হুজ্জাত হোসেন লিপু বলেন, 'কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোসের বাড়ি এই আসনে। এলাকায় তাঁর একটি কর্মিবাহিনী ছিল। সেসব নেতাকে বাদ দিয়ে মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনিও ফারুক খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে ছিলেন। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ার আলী আজম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। তখন আমি আলী আজমের দল করায় আমাকে কমিটির ভালো কোনো পদে রাখেননি। ১৯ বছর রাজনীতি করে আমি এখন একজন সদস্য। সব মিলিয়ে এই দলটির মধ্যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে।'
মুকসুদপুর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আ ক ম ফজলুল হক মিয়া (মিয়া ভাই) জানান, মুকসুদপুরে সব ধরনের কমিটি আছে। মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হলেও আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই দলের মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার আওয়ামী রাজনীতি মূলত লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খানের হাতে। তিনি তাঁর পছন্দের লোক দিয়ে এখানে কমিটি গঠনসহ সব ধরনের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। এমনকি স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে মন্ত্রী তাঁর পছন্দের লোক দিয়ে থাকেন। সিনিয়র-জুনিয়র না দেখে এমপি তাঁর পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি গঠন করেন। তাই শহীদুল ইসলাম বেলায়েত, মো. আলী মিয়া, গৌর চন্দ্র দাস এবং সরদার মুজিবুর রহমানের মতো লোকেরা এখন আর দল করেন না।
মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হাফিজুর রহমান জানান, ২০০২ সালে কমিটি হয়েছে। এরপর আর কোনো কমিটি গঠিত হয়নি। কেন্দ্র থেকে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, তা ঠিকমতোই পালিত হয়। আর এলাকার দলীয় কাজ কোনো রকমে চলছে। তবে তাড়াতাড়ি নতুন কমিটি করা হলে দলের অবস্থা কিছুটা পাল্টে যাবে।
মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আকরাম হোসেন জাফর বলেন, 'কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। নির্দেশ পেলে নতুন কমিটি গঠন করা হবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাদের এমপি কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তাঁর সাজেশনেই মূলত মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চলে। উপজেলা কমিটি গঠনের সময় তিনি উপস্থিত থেকে সবাইকে খুশি করেই কমিটি গঠন করে থাকেন।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুকসুদপুর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রমনা সংগঠন হলেও দীর্ঘদিন দলের সম্মেলন না হওয়া এবং বার বার একই লোক গুরুত্বপূর্ণ আসনে আসীন হওয়ায় দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিন দলের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব স্থান পাচ্ছে না। তাই দলটি সাংগঠনিকভাবে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.