মুন্সিগঞ্জে চার খাল দখল-‘নয়নের খাল’ আর নয়ন জুড়ায় না! by তানভীর হাসান

প্রশস্ত খালে চলত নৌকা। খালের পানি খুব স্বচ্ছ হওয়ায় মানুষ তা পানও করত। খালের মনোরম দৃশ্য নয়ন জুড়াত বলে এলাকাবাসী নাম দিয়েছিল ‘নয়নের খাল’। সেই খাল এখন আর নয়ন জুড়ায় না। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি বানিয়ে যে যেভাবে পেরেছে, খালটি দখল করেছে। ফেলেছে ময়লা-আবর্জনা। এতে শুকিয়ে গেছে খালের পানি। হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।


নয়নের খালটির অবস্থান মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নদীবন্দর এলাকা মিরকাদিম পৌরসভায়। এই খালটির পাশাপাশি পৌরসভার রিকাবীবাজার ও ফেচন্নীর খালও দখল হয়ে যাচ্ছে। দখলের কারণে পৌরসভার গোপপাড়া খালের অস্তিত্ব আর নেই। অথচ সরকারি এই চারটি খাল একসময় পরস্পর যুক্ত ছিল বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। অতি সম্প্রতি সরেজমিনে পরিদর্শন করে খালগুলো দখলের নানা চিত্র দেখা গেছে।
রিকাবীবাজার ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সহকারী কর্মকর্তা দানেসুর রহমান বলেন, ‘আমরা চারটি খালের দুই পাশের অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছি। তালিকা মোতাবেক কাজ চলছে।’
প্রথম আলোর কাছে ওই তালিকা রয়েছে। তালিকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাসহ ১৫২ জন দখলবাজের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮৮ জন রিকাবীবাজার, ৩৭ জন গোপপাড়া, ১৬ জন ফেচন্নী ও ১০ জন নয়নের খাল দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খাল দখলের ব্যাপারে মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দখলবাজদের কারণে নয়নের খাল ও রিকাবীবাজার খালের অধিকাংশ স্থান দখল হয়ে গেছে। গোপপাড়া খালটির অস্তিত্বও পাওয়া যাবে না।’
মেয়র বলেন, ‘আমরা এসব খাল উদ্ধারের চেষ্টা করছি। দখলবাজদের একটি তালিকাও স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ের মাধ্যমে করা হচ্ছে। খাল দখলমুক্ত করতে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে পৌরসভার পক্ষে আবেদন করা হয়েছে।’
নয়নের খাল: নয়নের খালের এক প্রান্ত রিকাবীবাজার খালে মিশেছে। সেখান থেকে বিনোদপুর উচ্চবিদ্যালয় হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মীরাপাড়া মসজিদসংলগ্ন গোপপাড়া খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খালটি। বিনোদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে খালের দুই পাশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি তুলে বেশির ভাগ অংশ দখল করা হয়েছে।
খাল ভরাট করে মিরকাদিম পৌর বিএনপির সভাপতি জসিম উদ্দিন দেওয়ান তুলেছেন গোয়ালঘর। পৌর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম তুলেছেন শৌচাগার। এ ব্যাপারে জসিম বলেন, ভূমি অফিসের সঠিক মাপজোখে যদি তাঁর গোয়ালঘর খালের সীমানায় পড়ে, তাহলে খাল দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে সবার আগে তিনি তাঁর গোয়ালঘর ভাঙবেন।
বিনোদপুর এলাকার মো. শহিদ বলেন, খালের ওপর করা তিনতলাবিশিষ্ট বাড়িটি তাঁর নয়। তাঁর ভাই আহসানউল্লাহর।
শহিদ বলেন, বিনোদপুর সড়কে খালের ওপর আগে একটি বড় সেতু ছিল। একসময় এখান দিয়ে নৌকা চলত। ওই সেতুটি ভেঙে নিচু করে নির্মাণ করায় নৌকা চলতে পারে না। এ সুযোগে আস্তে আস্তে লোকজন খাল দখল করে।
বিনোদপুর এলাকায় নয়নের খাল দখল করে পীর হাজির মার্কেট, সবুর সাহেবের মার্কেট, হক সাহেবের মার্কেটসহ অনেক স্থাপনা করা হয়েছে।
রিকাবীবাজার খাল: ধলেশ্বরী নদীর কাঠপট্টি ঘাট থেকে এই খালের শুরু। মিরকাদিম পৌরসভার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ইছামতী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই খাল দিয়ে ‘প্রাচ্যের কলকাতা’ বলে পরিচিত কমলাঘাট নৌবন্দরে বড় বড় নৌকা দিয়ে মালামাল পরিবহন করা হতো।
নূরপুর এলাকার মনির হোসেন বলেন, ‘এই খালের পানি একসময় সবাই পান করত, গোসল করত। বড় বোন মনোয়ারার বিয়ের সময় লঞ্চে করে বরযাত্রী এই খাল দিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। এখন এই খাল ভরাট করে দখল হয়ে গেছে। খালে পানিও নেই।’
রিকাবীবাজার খাল দখলের তালিকায় জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ, নূরপুর বাজার সমিতির সভাপতি মো. আমানউল্লাহর নাম রয়েছে। এর মধ্যে কামাল তাঁর বাবা হাজি সাবেদ আলীর নামে মার্কেট ও আমানউল্লাহ নূরপুর বাজারের পাশেই চারতলা বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে খাল দখল করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা কামাল বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি নাই। সবাই খালের উপর চইলা গেছে।’ তবে খালটি দখলমুক্ত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
আমানউল্লাহ দাবি করে বলেন, তাঁর চারতলা বাড়িটি দেখতে মনে হয় খালের ওপর চলে গেছে। আসলে খালের ওপর যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, রিকাবীবাজার খালের পূর্ব প্রান্তে সড়কের পাশে যেসব দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, তার প্রতিষ্ঠানের পেছনের অংশটুকু খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে পূর্বপাড়া পঞ্চায়েত কমিটি মার্কেট, নূরপুর পঞ্চায়েত কমিটি মার্কেট ও চারতলাবিশিষ্ট আজিজ প্লাজা নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিম প্রান্তে খালে খুঁটি পুঁতে দখল করে তৈরি করা হয়েছে আসবাবের বিভিন্ন দোকান। আসবাবের এই দোকানগুলো সরকারি জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বলে রিকাবীবাজার ভূমি কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে।
নূরপুর পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলীম হক বলেন, ‘এই খাল দখল করে নাই কে? সবাই দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে। সবাই তাদের দোকান ভেঙে সরিয়ে নিলে আমরাও সরিয়ে নেব।’
ফেচন্নীর খাল: মিরকাদিম পৌরসভার ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ফেচন্নী খালের অবস্থান। এই খালের পূর্ব অংশ দীঘিরপাড় খালে এবং পশ্চিম অংশ কমলাঘাট হয়ে উত্তরে গিয়ে রিকাবীবাজার খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দখলদারদের কারণে এই খালটিও বন্ধ হতে চলেছে।
এ ব্যাপারে মীরকাদিম পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হোসেন বলেন, খালটির অধিকাংশ ভরাট হয়ে গেছে। এর মধ্যে খালের কমলাঘাটের মুখে ভরাট করায় পানিও প্রবেশ করতে পারে না। এলাকার পরিবেশ রক্ষায় খালটি দখলমুক্ত করা জরুরি।
গোপপাড়া খাল: গোপপাড়া খালটি আড়াআড়িভাবে রিকাবীবাজার খালের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। অপর প্রান্ত প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মীরাপাড়ায় নয়নের খালের সঙ্গে যুক্ত হয়। এখন এই খালের অস্তিত্ব নেই। পুরো খাল ভরাট করে দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে।
মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি, দোকানপাট দেখিয়ে বলেন, ‘এখান দিয়ে গোপপাড়া খালটি প্রবাহিত হয়েছিল। এখন সবটাই দখল হয়ে গেছে।’
কালিন্দিপাড়ার রাঙাবালা (৫৫) তাঁর বাড়ির স্থানটি দেখিয়ে বলেন, ‘এখানে খাল ছিল। আস্তে আস্তে ভরাট হইয়া গেছে। ছোটবেলায় আমরা এই খালে নৌকা যাইতে দেখেছি। সবাই আস্তে আস্তে খাল ভরাট কইরা বাড়ি করছে। তাই আমার বাবাও করছে।’
ভেঙে পড়েছে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা: খাল দখলের ব্যাপারে মিরকাদিম পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাসুদ ইসলাম বলেন, ‘এই চারটি খালের অবস্থা দেখলে যে কেউ বলবে, মিরকাদিমে খাল দখলের মহোৎসব চলছে। খাল ভরাটের কারণে গোটা পৌরসভায় পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে।’
দখলমুক্ত করার উদ্যোগ: পরিবেশ অধিদপ্তর মুন্সিগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘মিরকাদিমে খাল দখলের বিষয়ে আমরা শিগগিরই খোঁজখবর নেব।’
জেলা প্রশাসক মো. আজিজুল আলম বলেন, ‘চারটি খাল দখলমুক্ত করতে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। এসব খাল দখলবাজদের কাছ থেকে মুক্ত করতে এলাকাবাসীকেও সহযোগিতা করতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.