অংসান সুচি-রাজনীতির মাত্র অর্ধেকটা আবেগ-(গতকালের পর)

ই প্রক্রিয়া কি কখনো পাল্টে যেতে পারে? ক্ষমতা কি আবেগ বা অনুরাগে পরিণত হতে পারে? যে ক্ষমতা রাজনৈতিক পরিবর্তন এনে থাকে, তাকে অন্যান্য ক্ষমতা থেকে পৃথক করে একটি ইউনিক ব্র্যান্ড হিসেবে দেখা যাবে না। দলের ক্ষমতা, অর্থের ক্ষমতা, গণমাধ্যমের ক্ষমতা, চাপ প্রয়োগকারী অন্য গ্রুপগুলোর ক্ষমতা এবং আরো অনেক ক্ষমতা বিপ্লব ও পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে থাকে। শাসক বা শাসকগোষ্ঠী হিসেবে ক্ষমতা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার শক্তির ওপর নির্ভর করে।


এর সঙ্গে আবেগের একটি পরিষ্কার দূরত্ব আছে বলে বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু স্বৈরশাসকের ক্ষমতা এবং গণতান্ত্রিকভাবে বিনিয়োজিত সরকারের ক্ষমতার একটি সাযুজ্য রয়েছে।
কোনো পরিস্থিতিতে কর্তৃত্বকারীরা রাজনৈতিক পরিবর্তন চান? যদি সব কিছু ভালোমতো, তাঁদের ইচ্ছামাফিক চলতে থাকে, তাহলে আর শাসকরা কোনো কিছু পরিবর্তনের দিকে মনোযোগী হন না। কিন্তু যখন সমস্যা তৈরি হয়, তখন কখনো কখনো তাঁরা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেন। যাঁরা বুদ্ধিমান শাসক, তাঁরা দ্রুত পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে পরিবর্তনকে কোনোক্রমেই পাশ কাটানো যাবে না। কিন্তু পরিবর্তনের কথা উপলব্ধি করা এবং সেটাকে বাস্তবে পরিণত করা এক কথা নয়। বহু মতের সমাজে সরকার একা কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। এর মধ্যে অনেক পক্ষ জড়িয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বিষয় নিয়ে দুই দলের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, তা প্রতিবাদকারীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা মনে করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেননি। এই পরিবর্তন শুধু প্রেসিডেন্ট একাই নন, দেশের অনেক মানুষই একটি প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করেন।
পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যদি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা হলে ওই ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। প্রতিশ্রুতি, একাগ্রচিত্ততা, প্রত্যয় হৃদয় জয় করার ক্ষমতা রাখে ক্ষমতার বিরোধিতার বেলায়। অন্য কথায় বলা যায়, ক্ষমতাই যখন পর্যাপ্ত নয়, তখন আবেগ-অনুরাগ সে জায়গাটাকে পূরণ করতে পারে।
অন্যদিকে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের জন্য নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অন্য ক্ষমতা বা অুনরাগকে সহজে ব্যর্থ করে দিতে পারে। একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার পরিবর্তনকে শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলেই দেখেন না, জাতির একটি চেতনা বলে মনে করেন একটি সময়ের জন্য। স্তালিনের নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারিতার সময় ত্রাস নাগরিকদের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করে। জনগণ নিজেদের অস্তিত্বের কথাই ভুলে যায়। এর পর একসময় যখন একনায়কের মৃত্যু হয়, তখন জনগণ দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে। জনগণ তখন জানতে চায় কী হয়েছিল, কেন এমন হলো? শুধু নিরেট ক্ষমতাই কি একটি সমাজকে পাল্টে দিতে পারে? স্তালিনের মধ্যে ক্ষমতা ব্যবহারের এমন একক চিন্তা কি করে কাজ করেছিল?
স্তালিন নিজে বিশ্বাস করতেন, এমন কোনো উদ্দেশ্য দ্বারা তাড়িত ছিলেন কি না, নাকি যে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা তিনি তাড়িত ছিলেন, সেটাই তাঁকে এমন কাজ করতে তাড়িত করেছে তা বলা যেত, যদি প্রাথমিকভাবে তাঁর নিষ্ঠুর বাহিনী চরম না হয়ে আবেগ দেখাতে পারত। তাঁর নিষ্ঠুর শাসন যখন অব্যাহত থাকে, তখন তাঁর মধ্যে অনড়, অভঙ্গুর ধারণা বদ্ধমূল হয়। আবেগের পরিবর্তে অন্ধত্ব কাজ করতে থাকে। এটাই তাঁকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অপরাধ করতে উৎসাহিত করে।
স্তালিন একাই তাঁর সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেননি; তাঁর বিশালসংখ্যক সহযোগী ছিল, যারা সচেতনভাবে, ইচ্ছা করে তাদের আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে ওই নিষ্ঠুরতা ঘটিয়েছিল। তাদের আবেগ অনুসারে তারা বিশ্বাস করত, একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং সামাজিক পরিবর্তনে। তারা মনে করত, স্তালিনই দেশের জন্য অর্জন করতে পারবেন। ক্ষমতা আবেগকে পরিচালিত করতে পারে এবং ক্ষমতারও এর এজেন্ট হিসেবে আবেগের প্রয়োজন রয়েছে।
এর সব শক্তির মধ্যে ক্ষমতা আবেগের চেয়ে কম আত্মনির্ভরশীল। আবেগ নিজের শক্তির জায়গাটিকে পরিচালিত করে। এটি নিজেই একটি শক্তি। আবেগ নিজের মধ্যেই একটি শক্তি, যা তার স্বভাব অনুসারে সঞ্চালিত হয়। অন্যদিকে ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবেই নিজেকে রক্ষা করার দিকে এগোয়। ক্ষমতা যখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পক্ষে মুখ করে এগোয়, তখন (হয় বহিঃশক্তির দ্বারা, অথবা আন্দোলন কিংবা নির্বাচনের ভবিষ্যৎ দ্বারা) তা অপ্রতিরোধ্য
হয়ে ওঠে।
প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বদলে আবেগই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন টিকে থাকার স্থায়িত্ব। আর সে কারণেই আবেগ এবং ক্ষমতাকে একসঙ্গে কার্যকর করে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আমরা সবাই পরিবর্তন চাই। কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই যে সে পরিবর্তন স্থায়ী হবে। অথবা এ পরিবর্তন প্রত্যাশা পূরণ করবে_এমন নিশ্চয়তাও নেই। আমরা যখন অজানার দিকে এগোই, তখন সব সময় একটি অনিশ্চয়তার ঝুঁকি থেকে যায়। ২০১২ সালে বার্মার এবং আরব বসন্তের জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তারা যে আন্দোলনের ফল উপভোগ করতে চায়, সেটা পেতে হলে ক্ষমতা এবং আবেগকে একত্র করে মেশাতে হবে। সেটাই হবে বুদ্ধিমত্তা। এ দুটোকে একসঙ্গে মেশালেই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।

লেখক : নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্মার রাজনৈতিক নেত্রী। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন।
ভারতের আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা নিবন্ধের শেষাংশ।
ভাষান্তর করেছেন মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.