প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি-কেউ কথা রাখে না

গোপালগঞ্জ-১ আসন। এ আসন থেকে তিন তিন বার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হন ফারুক খান। আশা ছিল উন্নয়ন হবে। কিন্তু সেই আসা পূরণ হলো না। এলাকার উন্নয়ন না হয়ে হয়েছে ব্যক্তির। মহাজোট সরকার তাঁকে প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী বানিয়েছে। ভাগ্যের উন্নয়ন যা হয়েছে তা মন্ত্রীরই হয়েছে।


আমরা যারা সাধারণ জনগণ আছি তারা কোনো সুযোগ-সুবিধার মুখ পর্যন্ত দেখিনি।' কথাগুলো বলেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুকসুদপুরের বেশ কয়েকজন আ. লীগের নেতা-কর্মী। তাঁরা বলেন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত টিআর, কাবিটা বিভিন্ন ইউনিয়নে বরাদ্দ দেখিয়ে দলীয় কিছু নেতা-কর্মী ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। সাধারণ মানুষের এসব সরকারি কর্মসূচি তেমন কাজে লাগেনি।
দিগনগর বাজারের বিল্ডার্স ব্যবসায়ী মো. বাবুল শেখ বলেন, 'এমপি ও মন্ত্রী ফারুক খান এই পর্যন্ত যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কোনোটাই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। দিগনগর ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে নির্বাচনের ১৬-১৭ দিন আগে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে তিনি বলেছেন "নির্বাচিত হলে আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে সর্বপ্রথম কুমার নদের ওপর সেতু নির্মাণ করবেন। কিন্তু তার কিছুই এখনো হয়নি। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর গত কোরবানির ঈদে কিছু সদকার কাপড় বিতরণ করার সময় আমি জিজ্ঞেস করি, আপনার প্রতিশ্রুত সেই সেতু কবে হবে? তিনি 'হবে' বলে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আগামী নির্বাচনে আবার যদি নমিনেশন পান তাহলে তাঁর যে কী হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।" প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আপনার এমপি গত তিন বছরে বদনাম ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এবার নতুন নেতা নির্বাচন করুন।'
সৈদ্দি গ্রামের আবদুল মান্নান মিয়া (৬০) বলেন, "নির্বাচনের আগে আমাদের ফারুক খান বলেছিলেন, আপনারা আমারে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। সরকার যদি এই কুমার নদের ওপর ব্রিজ নাও করে দেয় তাহলে আমি আমার নিজের গাঁটের টাকায় ব্রিজ করে দেব। আমরা ৯৫ শতাংশ ভোট দিয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছি। কিন্তু তিনি আমাদের ব্রিজ তো দূরের কথা, একটা বাঁশও কিনে দেননি। সামনে ভোট নিতে এলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা 'না ভোট' দেব । আর যদি অন্য কোনো দল আমাদের ব্রিজ করে দেয়, তাহলে তাদেরই ভোট দেব।"
বিশ্বম্বরদি গ্রামের শাজাহান শেখ (৫৩), গদার ভাজনদি গ্রামের আবদুল হাই (৫০), মো. শাহীন মিয়া (৪২), সানোয়ার মিয়া (৩৩), কানুরিয়া গ্রামের বালা ফকির (৫৫), সৈদ্দি গ্রামের কামরুল ইসলাম ইকো (৪৬), চরপ্রসন্নদি গ্রামের মাসুদ আলী (২২) বলেন, "আমাগে দুই-দুইবার ওয়াদা দিয়েও ব্রিজ করেনি। প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ দেয়ার কথা তাও দেয়নি। ভাবছিলাম তৃতীয় বারের ওয়াদা ভঙ্গ করবে না। তাই এবারও ভোট দিয়ে তাকে এমপি বানায়ছি। তিন বছর পার হলো। কোনো কাজের কাজ হয়নি। আমরা নৌকা মার্কার লোক। ভোট আমরা নৌকায়ই দিব, তবে ফারুক খানকে না। আওয়ামী লীগ যদি আগামীতে ফারুক খানরে নমিনেশন দেয়, তাহলে আমরা 'না ভোট' দিব।"
ছাগলছিঁড়া গ্রামের আবদুস সামাদ শেখ (৬৭) বলেন, 'ফারুক খান আমাগে গ্রামে নির্বাচনের আগে মিটিং করে বলেছিল, আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দিব। সবার খেদমত করব। এই কারণে আমরা ভোট দিছিলাম। কিন্তু পরে আর আসেনি।'
সৈদ্দি গ্রামের মহিত শেখ (৪৫) বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান রবিউল আলম সিকদার হচ্ছেন মন্ত্রীর ডানহাত। তিনি যা বলেন মন্ত্রী তাঁর কথামতো চলেন। রবিউলকে যে এলাকা থেকে নির্বাচনের সময় ভোট কম দিয়েছে, সেসব এলাকায় উন্নয়ন হচ্ছে না। রবিউল মন্ত্রীর দোহাই দিয়ে নিজের আখের গোছাচ্ছে। মুকসুদপুরে যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা মন্ত্রীর বাড়ি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ির এলাকায়।
মুকসুদপুর উপজেলা সদরের কমলাপুর খালের ওপর একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙা বেইলি ব্রিজ রয়েছে। এটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন পারাপার হচ্ছে। এই ব্রিজটি ভেঙে একটি নতুন ব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন ফারুক খান। এ সময় তিনি মুকসুদপুর ডিগ্রি কলেজকে সরকারীকরণেরও ঘোষণা দেন। দীর্ঘ তিনটি বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একই কথা বললেন, মুকসুদপুরের কমলাপুর গ্রামের হুজ্জাত হোসেন লিটু। তিনি আরো বলেন, মন্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিয়ে সরকারের বরাদ্দকৃত কাবিখা ও কাবিটার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। এমপি ফারুক খান নির্বাচনের সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার এক শতাংশও পূরণ হয়নি। এসব বিষয় দলের তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসতে হবে।
কাশিয়ানী উপজেলার ১৫-১৬ জন মুরবি্ব বলেন, 'আপনি যদি আমাগের নাম প্রকাশ না করেন তাহলে বলি।' তাঁদের নাম প্রকাশ করা হবে না বলায় তাঁরা বলেন, জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন তাঁর নির্বাচনী এলাকা। এসব মানুষের ভোট পেতে তিনি কাশিয়ানীর মধুমতী নদীর তীরে ইপিজেড নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনসভায় তিনি বলেছিলেন, 'আমি নির্বাচিত হলে আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কাশিয়ানীতে ইপিজেড নির্মিত হবে। এ এলাকার প্রতিটি ঘরের বেকার ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হবে।' কিন্তু ইপিজেড তো দূরের কথা, একখানা ইটও এলাকায় আসেনি। কাশিয়ানী সদরের এম এ খালেক ডিগ্রি কলেজে ভবনের অভাবে শিক্ষার্থীরা ছাদের উপর শেড তৈরি করে ক্লাস করে। এই কলেজে একটি নতুন ভবন করার ঘোষণা ছিল এমপি ফারুক খানের। জিসি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নতুন ভবন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সুফল আসেনি। তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যেসব রাস্তা ভাঙাচুরা সেগুলো সংস্কার ও উপজেলা সদরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ উন্নত করতে নতুন রাস্তা নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.