পাকিস্তান-সেনাবাহিনী ও রাজনীতির অশুভ প্রণয় by মাহির আলি

সেনাপ্রধান অনেক দিন পর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন— যিনি আবার নাকি তাঁর বস। পরপরই প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ফরহাতুল্লা বাবর দুজনের মধ্যে যা হয়েছে তাকে চার গুণ বাড়িয়ে স্বর্গীয় সমাধান হিসেবে দেখালেন। বললেন, ‘এ বিষয়ক সংবাদগুলো অতিরঞ্জিত, কল্পনাপ্রসূত এবং অনুমানজাত’।


সমস্যা হলো, পাকিস্তানের খবরগুলোর বেশির ভাগই তাঁর বলা ধরনগুলোর কোনো না কোনোটির মধ্যে পড়ে। সরকারি মুখপাত্রদের খাসলতই এর অন্যতম কারণ। তাঁরা মনে করেন, যত কম জানানো যায় ততই ভাল। অনেক সময় সবচেয়ে সরল প্রশ্নেরও আজব উত্তর আসে।
যেমন ধরুন, গত সপ্তাহে আসিফ আলী জারদারি পুনর্বার ‘দুবাই চলো’ ঝোঁকে পড়লেন, সব জল্পনা-কল্পনা মিথ্যা করে আবার ফিরেও এলেন। তাঁর মুখপাত্রকে জিজ্ঞেস করা হলো, প্রেসিডেন্ট কি জাতীয় পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন? জোরদার উত্তর এল: ‘মোটেই না। কেন তিনি তা হবেন?’
সম্ভবত তাঁর উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষ উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় তিনি দুবাইয়ে দৌড়েছিলেন সম্ভবত এই কুছ পরোয়া নেই ভাবটা বোঝাতে। কিছুদিন আগে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যার সময়েও তাঁর এই কুছ পরোয়া নেই ভাব প্রদর্শিত হয়েছিল।
বাস্তবতার সঙ্গে দূরত্ব বোঝাতে প্রেসিডেন্টের সবসময় একজন মুখপাত্রের প্রয়োজন পড়ে না। গত মাসে বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বলছি, রাজনীতি হলো...সম্ভবপরতার শিল্প। কিন্তু জাতি নির্মাণ হলো অসম্ভবের শিল্প এবং আমার বিশ্বাস, আমি সেই শিল্পটাই করছি।’
জাতি নির্মাণ? নিশ্চয়ই এটা তাঁর কোনো অতি গোপন প্রকল্প। কিন্তু জাদুকর হিসেবে কোনো যোগ্যতা তাঁর আছে কি না, আগামী দিনে শোচনীয়ভাবে তা প্রমাণিত হবে।
ফেডারেল সরকার আর সামরিক হাইকমান্ডের মধ্যে সংঘাত এই বাড়ে তো এই কমে। এমন পরিস্থিতিতেই জন্মায় অজস্র অনুমান। আজকের কঠিন তিরস্কার কালকেই হয়ে যায় সমঝোতার বাণী। অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এখনো তিরোহিত হয়নি। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উত্থাপন হতে পারে এক ট্র্যাজিক পরিহাসের প্রথম অঙ্ক, যার সমাপ্তি হবে হয়তো আগামী কয়েক দিনের মধ্যে।
এখানে আসল বিষয় হলো, জাতীয় সমঝোতা অর্ডিন্যান্স (এনআরও)। পারভেজ মোশাররফ এই বিল তৈরি করেন আর আদালত এটাকে বাতিল করেন। এই রায়ের কিছু সারবত্তা থাকলেও কল্পনা করা কঠিন, কেন সরকার আদালতের এমন এক নির্দেশ মানবে, যার অর্থ হচ্ছে বন্দুক তুলে নিয়ে নিজের পায়ে গুলি করা?
ইসলামাবাদের আনুষ্ঠানিক অনুরোধে সুইস কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত আবার শুরু করবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত, এই খেলার কোনো কোনো খেলোয়াড় স্বদেশে জারদারির প্রেসিডেন্টসুলভ বর্ম ভেদ করার উপায় খুঁজতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে, জোট সরকারের জ্যেষ্ঠ কিছু অংশীদার বেচারা গিলানিকে আজকের আদালতের সমনে সাড়া দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই এই মোলাকাত হবে নাটকীয়।
ক্ষমতাসীনদের জন্য পিছু হঠার বিন্দুটা ছিল চিঠি কেলেঙ্কারি (মেমোগেট)। যেখানে এ ঘটনার প্রাথমিক সাক্ষী নিজেই নিজেকে খণ্ডন করায় উন্মুখ, সেখানে এই নোংরা ব্যাপারটা কোনো আদালতে কীভাবে ওঠে, সেটা দেখা আসলেই কঠিন, । কী কারণে মনসুর ইজাজ সেই গোপন চিঠি হস্তান্তরের কয়েক মাস পর ঘটনাটা ফাঁস করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
এটা কি প্রচার পাওয়ার ইচ্ছা, নাকি ক্ষমতাকাঙ্ক্ষা? এটা কি কোনো তরফ থেকে হুমকি বা খোঁচাখুঁচি? আর কিছু না হোক সন্দেজনক যোগাযোগের জন্য রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানির শাস্তি হওয়া উচিত।
সত্যি বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করার কারণের কোনো অভাব নেই। তাহলেও ক্ষমতার হস্তান্তর, আরও সঠিকভাবে বললে, নির্বাচিত পদের পরিবর্তন গণতান্ত্রিকভাবেই হতে হবে। কিন্তু এই নিয়ম বাস্তবায়ন করা তত দিন পর্যন্ত অসম্ভব হবে, যত দিন সেনাবাহিনী পর্দার আড়াল থেকে রাজনীতির কলকাঠি নাড়বে।
পাকিস্তানের বয়সের অর্ধেকটা জুড়েই সরাসরি সেনাশাসন ছিল এবং সবভাবে ও সব মাত্রায় তা পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আবির্ভাবের আগের কূটচাল ও ফন্দিবাজির যুগ আবার ফিরে এসেছে। সত্য যে, বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফের ১১ বছরের শাসনকালও বলার মতো ছিল না। কিন্তু মোশাররফের আগমনে যে উল্লাস দেখা গিয়েছিল, সেটাও ছিল হঠকারী।
এই ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলার অবস্থার থেকে ভালো বিকল্পের প্রতি সহানুভূতিশীল না হওয়ার কী আছে? তাহলেও বর্তমান জোটের বদলে পরের জোট সরকারটি যে ভালো হবে তার নিশ্চয়তা কী? এটা এক করুণ পরিস্থিতি। কিন্তু এই ধাঁধার একমাত্র উত্তর নিহিত রয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে, যদি সেই গণতন্ত্রকে আমরা হঠাৎ দেখা স্বপ্ন হিসেবে নয়, দীর্ঘমেয়াদি চর্চা হিসেবে নিই।
পরিস্থিতি যা, তাতে মধ্যবর্তী নির্বাচনই হতে পারে সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কম কষ্টদায়ক পথ। কিন্তু বারবার মধ্যবর্তী নির্বাচন ফিরে আসার পরিস্থিতি ঠেকিয়ে রাখার জন্য দরকার আরও অনেক কিছু করা। স্বল্প মেয়াদে, বিচার বিভাগ কি তার পরিচয়সংকট কাটিয়ে উঠে নিজেকে কেবলই বিচারিক সংস্থা হিসেবে ভাবতে পারবে? মধ্য মেয়াদে, সেনাবাহিনী কি রাজনীতির সঙ্গে তার অবৈধ প্রণয়ের ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসার মতো বুঝমান হতে পারবে? দীর্ঘ মেয়াদে কী করতে হবে, তা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে এম কেইনস তো বলেই গেছেন: দীর্ঘ মেয়াদে ধরল আমরা তো সবাই-ই তো মৃত।

পাকিস্তানের দি ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
মাহির আলি: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.