জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি-পরাবাস্তববাদী ওডিসিয়াস ইলেতিস-ভূমিকা ও ভাষান্তর by চন্দন চৌধুরী

লেখালেখি শুরু ১৭ বছর বয়সে। গ্রিসের অন্যতম প্রধান এই কবির নাম। পুরো নাম ওডিসিয়াস এলেপোডেলিস ইলেতিস। জন্ম গ্রিসে। ১৯১১ সালের ২ নভেম্বর ক্রিতের হার্কলিন শহরে প্রথম সূর্য দেখেছেন এই নোবেলজয়ী। নোবেল পুরস্কারটা ঝুলিতে আসে ১৯৭৯ সালে। ১৯৪০-৪১ সালে আলবেনিয়ায় ইতালীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তিনি।


সেই থেকেই তিনি গ্রিসে আলোচিত হয়ে আসছেন। বিরুদ্ধস্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে জেনে ফেলেছিলেন জীবনের সৃষ্টিশীলতার মর্মার্থ। গ্রীসের ঐতিহ্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্মাণ করেছিলেন নতুন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার ইতিহাস। তবে সেটা ছিল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও যৌক্তিক প্রক্রিয়ায়। ইলেতিসের কথাও চমৎকার, 'আধুনিক মানুষ যুদ্ধ করছে স্বাধীনতা ও সৃষ্টিশীলতার জন্য।'
ইলেতিসের কবিতার প্রধান বিষয় পরাবাস্তববাদ। এই মতবাদের সূত্রপাতও ইউরোপে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। তাই বলা যায়, পরাবাস্তবতার গণ্ডির ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠেছেন ইলেতিস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক বিধ্বস্ততায় অনেকেই বাস্তবের ওপর আস্থা হারায়। চেতনায় ধরা দেয় বিষাদ। তাই মানুষের আশার রূপটি বেঁচে থাকল নিজেরই ভেতর। বাস্তবের নৈরাশ্য দিয়ে বাস্তবকেই বিনির্মাণ করল মানুষ অবচেতনের পৃথিবীতে। সেই তত্ত্বটাকেই 'সুররিয়ালিজম' নামকরণ করেছেন গিয়োম আপোলোনেয়ার ও আন্দ্রে ব্রেতোরা। এই শিল্পতত্ত্বের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীর যাবতীয় সাহিত্যকে ভেঙে দিতে। সুররিয়ালিজমের মূলকথা, পূর্ণ মানসিক মুক্তি; ন্যায়পরম্পরা থেকে, সামাজিক ঔচিত্যবোধ, প্রচলিত নৈতিকতা থেকে, বাক্যের অন্বয় থেকে, যাবতীয় অনুশাসন থেকে মুক্তি।'
সৃজনশীল পৃথিবীর যে অনুশাসন, তাকে মুক্ত করতেই শুরু হয়েছিল এ বিপ্লব। এই বিপ্লবে কমিউনিস্টরাও অংশ নিয়েছিল। কারণ কমিউনিস্টরা চেয়েছিল সমাজবাস্তবতাকে ভেঙে দিতে। একদিকে বাস্তবতাবোধ এবং অন্যদিকে সমাজবাস্তবতা_দুটি বিষয় যেমন কাছাকাছি ছিল, তেমনি দুটির মধ্যে আবার পার্থক্যও রয়েছে। তথাপি তারা এক হতে পেরেছিল বিপ্লব চাওয়ার প্রশ্নে। সুররিয়ালিস্টদের এক ইশতেহারে পাওয়া যায়_'তথাকথিত সাহিত্যের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নেই, বিপ্লব ঘটাতে তারা বদ্ধপরিকর। শ্রমিকের যেমন মাতৃভূমি নেই, তেমনি শিল্পীরও নেই।'
তবে ইলেতিসকে আমরা পাই সামান্য ভিন্নভাবে। কারণ তিনি পরাবাস্তববাদের সব কিছু একবাক্যে মেনে নেননি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, 'পরাবাস্তববাদের অনেক কিছু আমি গ্রহণ করতে পারিনি। যেমন এর প্যারাডঙ্গুলো, যেগুলো অবলীলায় আসে, গতিময় বিষয়।...' তবে আর যা-ই হোক, পরাবাস্তবই এই কবির পুঁজি। তা দিয়েই পৃথিবীর ক্ষমতাবান লেখকদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
এই তত্ত্বে পৃথিবীতে নির্মিত হয়েছে অনেক সাহিত্য, চিত্রশিল্প, চলচ্চিত্র, যেগুলো বড় বড় শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পিকাসো, দালি, এরনস্ট, ক্লি, কানদিস্কি, মিরো তাঁদের ছবি ও ভাস্কর্যে, লুই বুনুয়েলের চলচ্চিত্রে; মায়াকোভস্কি, নেরুদা, লোরকার কবিতায়, আর্তোর নাটকে, গিনস্বার্গের রচনায়; এগুলোতে পরাবাস্তবতার ভূমিকা বিশেষভাবেই লক্ষণীয়। এঁদের কথা বলতে গেলে আসে ইলেতিসের কবিতার কথাও আসে বাংলার জীবনানন্দের প্রসঙ্গও।
এই পরাবাস্তববাদী কবির জীবনটা ঘেঁটে দেখলে একটু আশ্চর্যই হতে হয়। ছিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৩৭ সালে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন কোর্ফো মিলিটারি স্কুলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে উত্তীর্ণ হন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে। যখন এই অবস্থা, তখন একজন কবি কী করতে পারেন! বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের নজরুলও সৈনিকজীবন পাড় করেছেন। আর তাই তাঁকে রৌদ্রময় বিপ্লবী কবি হিসেবে পাই। তাঁর কথায় ঝংকার আছে, শব্দে শব্দে টংকার বাজে। কিন্তু ইলেতিস হলেন পুরোপুরি ভিন্ন। তার কারণ অবশ্যই সে সময়ের ইউরোপে পরাবাস্তবতার প্রতাপ। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবি বলেছিলেন, 'আমি বিশ্বাস করি যে সুইডিশ একাডেমী আমাকে এই সম্মানটুকু দিয়েছে গ্রিক কবিতার ধারাকে পূর্ণাঙ্গতা দেওয়ার জন্য। পাশাপাশি আমি মনে করি, পৃথিবীতে হোমারের সময়কাল শেষ হয়ে গেছে, যা পশ্চিমা সভ্যতায় বিদ্যমান।' আর এভাবেই ভাঙার গান গেয়েছিলেন কবি। ইলেতিস গ্রিসের বাস্তবতায় পরাবাস্তববাদের সূচনা করেন। 'বাস্তব'-এর ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেন 'অধিবাস্তব'কে। তাঁর চিন্তায় আসে একজন তরুণী পরিবর্তন হয়ে হয় একটি ফল, মানুষের শরীরে ধারণ করে স্থূলদৃশ্যাবলি এবং সকালের দৃশ্যের উপমা নেওয়া হয় বৃক্ষ থেকে। তিনি বলেছেন, 'আমি প্রকৃতি ও ভাষার সাহায্যে কল্পনা তৈরি করার চেষ্টা করি। এটা পরাবাস্তববাদীদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।...এবং অবশ্যই সব কিছু চিন্তার ওপর নির্ভর করে। এটা এ রকম যে তুমি যা করছ, এবং এর ইন্দ্রিয়গোচর ভাবনা এক নয়, এটাই তুমি ও তোমার ভেতরের তোমার মধ্যে পার্থক্য।' 'ওরিয়েন্টেশনস' ইলেতিসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বইটির কবিতায় এসেছে পরাবাস্তববাদের ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ। বইটির কবিতাগুলো গীতল হাস্যোরসাত্মক। একজন সমালোচক লিখেছিলেন, 'এখানে আলো ও উষ্ণতা এসেছে ইলেতিসের সত্তা, শরীর ও আত্মা থেকে।'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও তাঁর কবিতা লেখা থামেনি। ছিলেন আলবেনিয়ায়। লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা, 'অ্যা হিরোয়িক অ্যান্ড এলিজাইয়াক সং অব দ্য লস্ট সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অব দ্য আলবেনিয়ান ক্যাম্পেইন'। এটা ছিল তাঁর ব্যতিক্রমী ও অন্যতম কাজ। এরপর ইলেতিস দীর্ঘ সময় নীরবই ছিলেন বলা যায়। তা টানা ১০ বছর। ১৯৬০ সালে তাঁর একটি বই পায় গ্রিসের জাতীয় গ্রন্থ পুরস্কার। ইলেতিসের কবিতার বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে ডজনের ওপর। অন্যদিকে তাঁর নির্বাচিত কবিতাসহ কয়েকটি বই ইংরেজিতেও পাওয়া যায়। তবে কোনোটির ভাষান্তর কবি নিজে করেননি। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সমালোচনার বই আছে তাঁর। আর সাহিত্যে অবদানস্বরূপ পেয়েছেন নোবেলসহ কয়েকটি মূল্যবান পুরস্কার। এই কবি পৃথিবী ত্যাগ করেছেন ১৯৯৬ সালে।

No comments

Powered by Blogger.