মূল্যস্ফীতি ও সুদহার-আমজনতার স্বার্থহানি ঘটাবেন না

মজনতা কেমন আছে, এমন প্রশ্ন করা হলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দ্বিধায় না পড়েই উত্তর দেবে_ মোটেই ভালো নেই। সরকার হয়তো দাবি করবে_ কৃষি ও শিল্প উৎপাদন, রফতানি আয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদসহ ম্যাক্রো-অর্থনীতির অনেক সূচক উৎসাহব্যঞ্জক। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত, দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা এসব তাত্তি্বক বিষয় নিয়ে কোনো আমলেই তেমন মাথা ঘামাতে রাজি থাকে না।


তাদের প্রধান দুশ্চিন্তা নিত্যদিনের বাজারদর নিয়ে। কৃষক-মজুররা মৌসুমের পর মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন এনে দিচ্ছে। এ বছর আলু ও শীতকালের সবজিও বিস্তর ফলেছে। উৎপাদকরা অভিযোগ করে চলেছেন_ ন্যায্যমূল্য মিলছে না। কিন্তু তারপরও বাজারে গিয়ে অনেকেরই স্বস্তি মিলছে না। মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের বেশি। আমন ধানের মৌসুম কেটে গেলে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হবে বলেই শঙ্কা। সরকার দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে আগুনে ঘি পড়ছে। যানবাহন ও বাড়ি ভাড়ার জন্য সব পরিবারকে বাড়তি অর্থ দিতে হচ্ছে। শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি করা পণ্যের জন্য বেশি মূল্য গুনতে হচ্ছে। শিল্পজাত পণ্যের দামও চড়া। এ অবস্থায় নতুন করে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঠিক হবে না, যা মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেবে। এমনিতেই তারা ভালো নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায় কিংবা কীভাবে তা প্রণীত হয়, সে বিষয়ে অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে সেটা উপলব্ধি করতে কোনো সমস্যা তাদের হয় না। তাদের আশা থাকবে, সরকার এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না, নিত্যপণ্যের বাজারকে যা আরও অস্থির করে তুলবে। বুধবার সমকালে প্রকাশিত 'আইএমএফের পরামর্শে সুদহার বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে' শিরোনামের খবরটি কিন্তু এমন আশঙ্কার কথাই বলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছ থেকে সরকার কয়েক মাস ধরে একশ' কোটি ডলার ঋণের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে টানাটানি পড়ায় সরকার এখন ঋণ পেতে উদগ্রীব। কিন্তু ঋণ পেতে হলে দেশীয় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়াতে হবে, এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোক্তারা মনে করেন_ দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশ উঁচুমাত্রায় রয়েছে এবং এ কারণে উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ছে। অন্যদিকে আইএমএফ বলছে, ঋণের সুদের হার কম এবং এ কারণে বাজারে মুদ্রার জোগান বেশি থাকছে, যা মূল্যস্ফীতির অন্যতম বড় কারণ। অতএব, তাদের পরামর্শ_ ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে মুদ্রার জোগান কমাতে হবে। কিন্তু যারা ঋণের গ্রহীতা তাদের যুক্তি_ ঋণের সুদহার বাড়ানো হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং এর প্রভাবে বাজারে পণ্যমূল্যও বেড়ে যাবে। তাদের শঙ্কা_ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে তা আরও বেড়ে যেতে পারে। আমরা এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করব। এর পরিবর্তে বরং সরকারকে 'নিজের কাঁধ থেকে' ব্যয়ের বোঝা নামিয়ে ফেলায় মনোযোগী হতে হবে। আর তা করতে গিয়ে উন্নয়ন কর্মসূচি খুব একটা কাটছাঁট করার দরকার পড়বে না_ দুর্নীতি-অপচয়ের লাগাম টেনে ধরলেই চলবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকেও এ বিষয়টি বোঝানো সহজ হওয়ার কথা।

No comments

Powered by Blogger.