শেয়ারবাজার ঘিরে চরম বিশৃঙ্খলা

দেশের শেয়ারবাজারকে কেন্দ্র করে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। বাজার ঘিরে সরকারের নীতিনির্ধারণী নানা সিদ্ধান্তে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাবে বাজারে আবারও বড় দরপতন ঘটছে। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া বিষয়ে কয়েক দিন ধরে বাজারে দরপতন চলছিল।


সোমবার থেকে শুরু হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা নিয়ে নতুন জটিলতা। সোমবার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা হওয়ার পর এক দিন লেনদেন বন্ধ থাকে। এরপর গতকাল বুধবার আবার লেনদেন শুরু হলেও দিনভর চলে নতুন নাটক।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে গতকাল বিকেলে একটি পরিপত্র জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। পুঁজিবাজারের টালমাটাল অবস্থায় বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্রটি জারি করা হয়। কিন্তু পরে সন্ধ্যায় সেটি প্রত্যাহার করা হয়।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার রাত পৌনে আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইংরেজি থেকে বঙ্গানুবাদ করার কারণে পরিপত্রের ব্যাখ্যায় একটু ভুল হয়েছে। এ জন্য আপাতত আমরা এই পরিপত্রটি প্রত্যাহার করেছি। পরিপত্রটি সংশোধন করে তা আবার জারি করা হবে।’
তবে এ নিয়ে জানতে চাইলে একজন পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করবেন না বলে জানান। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়টিকে এমনই হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে এ নিয়ে মন্তব্য করতেও আর ইচ্ছা হয় না।
তবে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে মতামত দেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারকে নিয়ে যা ঘটছে তা চরম সমন্বয়হীনতারই নজির। সরকারের মধ্যেই এই সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে। বাজারকে বাজারের মতো করেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
প্রত্যাহার করা পরিপত্রে যা ছিল: প্রত্যাহার করা পরিপত্রে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১৫-এর কথা ইংরেজিতে উল্লেখ করে নিচে বলা হয়, ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ফাটকা কারবারের বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করছেন। এ ধরনের বিনিয়োগ উক্ত বিধিমালা দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধের লঙ্ঘন। এ ছাড়া বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো গণকর্মচারীর ব্যবসায় জড়িত হওয়া আচরণবিধির পরিপন্থী।
‘উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী ফাটকা কারবারের বিনিয়োগ থেকে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো। একই সঙ্গে যেসব বিনিয়োগের ফলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সরকারি কার্য সম্পাদনা প্রভাবান্বিত হতে পারে অথবা সরকারি কর্তব্য সম্পাদনে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও এইরূপ (ফাটকা কারবার) বিনিয়োগে অনুমতি প্রদান না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
পরিপত্র জারির পর জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এ পরিপত্রের মাধ্যমে আমরা কেবল বিদ্যমান আইনের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যাতে নতুন করে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আর বিনিয়োগ করতে না পারেন। যাঁরা ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের বিষয়ে আমরা এখনই কিছু বলছি না।’
ঘটনার সূত্রপাত: গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে প্রথম আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ারে বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। এরপর সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস মন্ত্রিসভার বৈঠকের সংবাদ দিয়ে জানায়, ‘মন্ত্রিসভা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করার বিষয়ে সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে।’
এই সংবাদ প্রকাশের পর সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে দেশের দুই স্টক একচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এক দিনের জন্য লেনদেন বন্ধ করে দেয়। গতকাল আবার আধা ঘণ্টা পর লেনদেন চালু হলেও বাজারের দরপতন থামেনি। তবে লেনদেন শুরুর আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি সংবাদ সম্মেলন করে ভিন্ন কথা জানায়।
এসইসির সংবাদ সম্মেলন: গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে তড়িঘড়ি করে আয়োজন করা সংবাদ সম্মেলনে এক পৃষ্ঠার একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান এসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। বক্তব্যটি পাঠ করেই সাংবাদিকদের কোনো ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই তিনি সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন।
লিখিত বক্তব্যে এসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় আলোচনার কোনো পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না—এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সংগত কারণে এসইসি মনে করে যে এতে গত দুই দিনে পুঁজিবাজারে বিরাজমান সব গুজব, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তির অবসান হবে।’
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ‘গত ১৬ জানুয়ারির মন্ত্রিপরিষদ সভা শেষে সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে সংবাদপত্রে ও গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। প্রকৃত সত্য হলো, সেদিনের সভায় পুঁজিবাজারকে গতিশীল ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিপূর্বে এসইসি ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আয়কর আইনে সংশোধন আনা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৯৭৯ সালের সার্ভিস রুলের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে।’
সর্বশেষ সংবাদ: এসইসির চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যে অবশ্য আশ্বস্ত হননি বিনিয়োগকারীরা। এর পরও বড় ধরনের দরপতন ঘটে। দিনভর বিক্ষোভও করেন তাঁরা। আর বিকেলে পুরো বিষয়টিই হাস্যকর পর্যায়ে চলে যায়। বিকেলে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরে আরও নাটকীয়ভাবে পরিপত্রটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, পরিপত্রটি নিয়ে গতকাল রাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে নতুন করে পরিপত্র জারি করা হলেও তাতে নতুন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.