চিনি রপ্তানির অনুমতি দেবে সরকার!

দেশে চিনির বাজার থাকে নিয়ন্ত্রণহীন। এমনকি বাজার থেকে চিনি উধাও হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। অথচ সেই চিনি এবার বিদেশে রপ্তানি হবে। বিদেশ থেকে কম শুল্কে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন করার পর তা রপ্তানির অনুমতি চাইছে দেশের বেসরকারি পরিশোধনকারী কারখানাগুলো। সরকারও সীমিত আকারে সে সুযোগ দিতে সম্মত বলে জানা গেছে।


বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন গতকাল বুধবার চিনি পরিশোধন কারখানার মালিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর চিনি রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান।
বৈঠকে সমিতির সভাপতি ও সিটি রিফাইনারির চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, দেশবন্ধু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম রহমান, ঈগলু রিফাইনারীর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন মোনেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের ছয়টি পরিশোধন কারখানার (পারটেক্স গ্রুপের কারখানা বন্ধ) বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ৩৩ লাখ টন। আর দেশের চিনির চাহিদা ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন। রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হলে উৎপাদনক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনি রপ্তানি করা সম্ভব।
সভায় আরও জানানো হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিনি পরিশোধন কারখানা স্থাপন করেছে সিটি গ্রুপ। গত বছর তারা ৭৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ইউনিট উদ্বোধন করেছে, যার প্রতিদিনের উৎপাদনক্ষমতা পাঁচ হাজার টন। সিটি গ্রুপেরই ১৫ লাখ টনের সমান উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ সিটি গ্রুপ একাই দেশের মোট চিনির চাহিদা মেটাতে পারে। এস আলম গ্রুপও ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের কারখানা সম্প্রসারণ করেছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ কারখানার উৎপাদনক্ষমতা দুই হাজার ৬০০ টন। এ ছাড়া রয়েছে মেঘনা গ্রুপ, দেশবন্ধু রিফাইনারি ও ঈগলু রিফাইনারি।
বাণিজ্যসচিব সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রপ্তানির সুযোগ না থাকায় পুরো উৎপাদনক্ষমতা তাঁরা কাজে লাগাতে পারছেন না। অথচ পরিশোধন কারখানাগুলো স্থাপনই করা হয়েছে রপ্তানির বিষয়টি মাথায় রেখে। কিন্তু পরে আর রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়নি।
ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃতি দিয়ে চিনির দর পড়ে যাওয়ায় বর্তমানে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে বলেও জানান বাণিজ্যসচিব। তিনি বলেন, পরিশোধন কারখানাগুলোতে বর্তমানে ৪০ শতাংশ উৎপাদনক্ষমতা ব্যবহূত হচ্ছে। এটা ঠিক যে শুধু ৪০ শতাংশ উৎপাদনক্ষমতা দিয়ে কোনো কোম্পানি লাভজনক হতে পারে না।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চিনি পরিশোধন কারখানার মালিকদের একটি বৈঠক করতে হবে জানিয়ে গোলাম হোসেন বলেন, চিনি রপ্তানির সুযোগের সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে চিনি রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার আগে কয়েকটি ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন দরকার বলে মনে করেন নিত্যপণ্যের বাজার পর্যবেক্ষণকারীরা। তাঁদের মতে, চিনি রপ্তানির সুযোগে বেশকিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির সংকট দেখা দিলে বা রমজান মাসে দেশে চাহিদা বেড়ে গেলে কারখানাগুলো সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখবে কি না। দ্বিতীয়ত, কোনো নীতিমালা ছাড়া চিনি রপ্তানির অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। উদাহরণ দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে কারখানার মালিকেরা শুল্কসুবিধা নিয়ে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে থাকেন। দেশের ভোক্তাদের স্বার্থেই সরকার তাঁদের এই সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু এই শুল্কমুক্ত সুবিধায় পাওয়া চিনি পরিশোধন করে রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে কি না, ভাবার বিষয়।
তৃতীয়ত, কী পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি রপ্তানির জন্য আনা হচ্ছে এবং কী পরিমাণ চিনি রপ্তানি হচ্ছে, সে বিষয়টি সরকারের নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে, যাতে ঘোষিত চিনির চেয়ে বেশি রপ্তানি করলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। চতুর্থত, রপ্তানির জন্য আনা অপরিশোধিত চিনির জন্য শুল্ক আদায় করতে হবে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিবেশক ও ব্যবসায়ীদের: চিনি রপ্তানির সুযোগের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন পরিবেশক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
যোগাযোগ করলে একজন পরিবেশক বলেছেন, রমজান মাসে যখন চিনির চাহিদা বেশি থাকে তখন তাঁরা বাজারে চিনি সরবরাহ করতে পারেন না, আর এখন করবেন রপ্তানি—বিষয়টি হাস্যকর।
পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য ও কয়েকটি চিনি কারখানার পরিবেশক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, এটি খুব ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ, তাঁরা তখন দেশের বাজারে কম দামে চিনি বিক্রি না করে বরং বিদেশের বাজারে বেশি দামে রপ্তানির দিকে ঝুঁকবেন।
তবে চিনি রপ্তানির অনুমতির বিষয়টিকে স্বাগত জানান মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সরবরাহ আদেশ (ডিও) প্রথা বন্ধ করে দিয়ে সরকার চিনি ব্যবসাকে সংকুচিত করে ফেলেছে। এখন রপ্তানির সুযোগ দিলে বরং ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.