স্মরণ-বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর-নায়ক

৯৭১। ২৫ মার্চের রাতে মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিলেন হামিদুর রহমান। ফেরার সময় মাকে বলেন, 'ঈদে খরচ পাঠাব। কোনো চিন্তা কোরো না।' 'দুই মাসও হয়নি হামিদুর মিলিটারিতে ভর্তি হয়েছে। এরই মধ্যে রাতের বেলা বাড়ি এল কেন? আবার চুপিচুপি ভোর রাতে চলেই বা যাচ্ছে কেন? একটা পুরনো লুঙ্গি আর শার্ট পরে বাড়ি এসেছে, সে কিভাবে সংসারের অভাব ঘোচাবে, ভাইবোনদের কিভাবে দেবে নতুন জামাকাপড়?'_মায়ের মনে শত প্রশ্ন।


মনের ভেতর ভয় আর উদ্বেগ নিয়ে দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে সেদিন বিদায় দিয়েছিলেন ছেলেকে। সিপাহি হামিদুর রহমান দেশকে হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। শ্রীমঙ্গল থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে ধলই সীমান্ত ঘাঁটি। এরই মধ্যে চা বাগানের মাঝে আস্তানা গেড়েছে পাকিস্তানি হানাদাররা। ২৮ অক্টোবরের ভোররাত। জেগে আছে মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট। এই ইউনিটের ওপর দায়িত্ব পড়েছে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে ধলই সীমান্ত ঘাঁটি দখল নেওয়ার। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোররাতে আক্রমণ করা হবে ঘাঁটিতে। এ দলেরই তরুণ যোদ্ধা হামিদুর রহমান। আক্রমণের জন্য তৈরি ইউনিটটি। সামনে দুই প্লাটুন সেনা এবং এক প্লাটুন পেছনে। অধিনায়কের আদেশে শেষবারের মতো শত্রু সেনার অবস্থান দেখে নেওয়ার জন্য চুপিসারে একটি গাছে উঠলেন হাবিলদার নজরুল। ঠিক তখনই গর্জে উঠল হানাদার বাহিনীর রাইফেল। অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম বুঝে ফেললেন, শত্রুরা তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। তাই আক্রমণ করতে হবে শত্রুর লক্ষ্য পরিবর্তন করে। ওয়্যারলেসে গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসারের সঙ্গে কথা বললেন অধিনায়ক। শত্রুবাহিনীর ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করতে বললেন, তাহলেই হয়তো শত্রুর লক্ষ্য বদলে যেতে পারে। এই সুযোগে পদাতিক বাহিনী আক্রমণ করবে। বাঙালি গোলন্দাজ বাহিনীর কামান গর্জে উঠল। গোলাবর্ষণে ধলই ঘাঁটিতে আগুন ধরে গেল। আকস্মিক আক্রমণে হানাদারদের মনোবল ভেঙে গেল। এই সুযোগে ডান দিক, বাম দিক ও পেছন দিক থেকে আক্রমণ করল তিন প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা আরো অগ্রসর হলেন। কিন্তু একটি এলএমজির কারণে তাঁরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। তা থেকে মুহুর্মুহু বেরিয়ে আসছে বুলেট। সামনে এগোতে হলে অবশ্যই এলএমজিটা থামিয়ে দিতে হবে। জীবনবাজি রেখে এগিয়ে গেলেন হামিদুর রহমান। উভয় পক্ষের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো অনবরত গর্জে উঠছে। যেকোনো সময় ফুটতে পারে মাইন। এসব উপেক্ষা করে হামিদুর পেঁৗছে গেলেন এলএমজিটার কাছাকাছি। দুই এলএমজি চালকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করলেন। তিনিও শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হলেন। মুক্তিসেনারা ঢুকে গেলেন ধলই সীমান্ত ঘাঁটিতে। এলএমজি পোস্টের কাছে দৌড়ে এসে পেলেন শহীদ হামিদুর রহমানের মৃতদেহ। ধলই বর্ডার আউটপোস্ট দখল হলো সিপাহি হামিদুর রহমানের অসীম সাহসিকতার জন্যই। এই অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই মহান বীরসেনানীর নামে তাঁর জন্মস্থান ঝিনাইদহের মহেশপুর থানার খোর্দ খালিশপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে হামিদনগর।
আরাফাত শাহরিয়ার

No comments

Powered by Blogger.