তাঁদের স্মরণে উৎসব by মামুন মিজানুর রহমান

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের চতুর্থ মহাপ্রয়াণ দিবসে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সেলিম আল দীনের তীর্থভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হয়েছিল সেলিমচর্চায়। অন্যদিকে ১৫ জানুয়ারি ছিল উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রণেশ দাশের জন্মশতবার্ষিকী। লিখেছেন মামুন মিজানুর রহমান।


সেলিম আল দীন স্মরণে নাট্যজন সেলিম আল দীনের চতুর্থ প্রয়াণ দিবসে দেশের বিভিন্ন নাট্যদল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসমারোহে আয়োজন করেছে ভিন্ন ভিন্ন স্মরণোৎসব।
সেলিম আল দীন ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব। উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় একই সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীতে উৎসব উদ্বোধন করেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নাসির উদ্দীন ইউসুফেtrocorouর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেলিম আল দীনের স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা। 'রবীন্দ্রভুবনে সেলিমের ভ্রমণ' শীর্ষক গবেষণা এবং সংগীত পরিবেশন করেন মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসুফ। আলোচনা পর্ব এবং এশা ইউসুফের পরিচালনায় চিত্র প্রদর্শনসহ নানা আয়োজনে মুখর ছিল সারা দিন। ছুটির দিন বলে সেলিমপ্রেমীদের ভিড় একটু বেশিই ছিল। উৎসবের চার দিন মঞ্চস্থ হয় সেলিম আল দীন রচিত তিনটি নাটক। উদ্বোধনী দিনে ঢাকা থিয়েটার পরিবেশন করে শিমূল ইউসুফের নির্দেশনায় 'ধাবমান'। দ্বিতীয় দিন ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পরিবেশনায় এবং সুমন কুমারের নির্দেশনায় 'কিত্তনখোলা'। তৃতীয় দিনের পরিবেশনায় ছিল বুনন থিয়েটারের পরিবেশনায় এবং আনন জামানের নির্দেশনায় 'চাকা'।
১৪ জানুয়ারি মৃত্যু দিবসের আয়োজনে ছিল কিছুটা ভিন্ন মাত্রা। সকাল ৮টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সেদিনকার আয়োজন। সন্ধ্যায় পরীক্ষণ থিয়েটারে পরিবেশিত হয় ঐতিহ্যবাহী কবির লড়াই। এই মধুর লড়াইয়ে অংশ নেন দিনাজপুরের জয়গুরু কবি সম্প্রদায়ের কবি ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকার এবং রিক্তা কবি সম্প্রদায়ের কবি মালতী রানী সরকার। নর-নারীর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীতেও একই সময়ে উদ্যাপিত হয় দুই দিনব্যাপী সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব। উদ্বোধন করেন ঢালী আল মামুন। প্রথম দিন সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয় গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের পরিবেশনা ও ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর নির্দেশনায় 'সংবাদ কার্টুন'। একই দিন পরিবেশিত হয় 'নাট্যধারা'র প্রযোজনায় পার্বত্য আদিবাসী আখ্যান 'ভগা কাইন'। দ্বিতীয় দিন ছিল অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের পরিবেশনা এবং শিশির দত্ত ও মুনির হেলালের নির্দেশনায় 'বাসন'। উৎসবের শেষ নাটক ছিল প্যান্টমাইম মুভমেন্টের 'প্রাচ্য'। উৎসব আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ও ঢাকা থিয়েটার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'স্বপ্নদল' সেলিম আল দীন স্মরণে দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করে। এতে যোগ দেন জাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং নাট্যপ্রিয় মানুষ। সকাল ৯টায় এই উৎসবের উদ্বোধন করেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কলা ভবন থেকে নাট্যাচার্যের সমাধি পর্যন্ত স্মরণ-শোভাযাত্রায় যোগ দেন অসংখ্য নাট্যামোদী ব্যক্তি। সকাল সাড়ে ১০টায় সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে 'স্বপ্নদল' মঞ্চায়ন করে সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথার নাট্যরূপ 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি'। নাট্যরূপ দিয়েছেন ড. জাহারাবী রিপন, নির্দেশনা উপদেষ্টা জাহিদ রিপন এবং নির্দেশনায় সামাদ ভুঁইয়া ও রওনক লাবণী। সকাল ১১টায় ছিল নাট্যাচার্যকে নিয়ে স্মৃতিকথার আয়োজন এবং নবীন নাট্যকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়। বিকেল ৩টায় অডিটরিয়ামে 'স্বপ্নদল'-এর পরিবেশনায় ছিল সেলিম আল দীনকে নিবেদিত 'পুণ্যশ্লোক হে সেলিম আল দীন' শীর্ষক সংগীত-কোরিওগ্রাফি। এর পর পরই অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। এতে 'সেলিম আল দীনের শিল্পদর্শন' শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. জাহারাবী রিপন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে স্বপ্নদল মঞ্চায়ন করে জাহিদ রিপনের নির্দেশনায় সেলিম আল দীনের কালজয়ী সৃষ্টি 'হরগজ'।

রণেশ দাশগুপ্ত স্মরণে
রণেশ দাশগুপ্ত একজন মার্কসবাদী তাত্তি্বক ও আজীবন বিপ্লবী পুরুষ। আজকের উদীচীর প্রতিষ্ঠা ও জয়যাত্রার পেছনে এই মানুষটির রয়েছে অসামান্য অবদান। ১৫ জানুয়ারি তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। ১৩ জানুয়ারি 'কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক' স্লোগান নিয়ে বিকেল ৪টায় শুরু হয় তিন দিনব্যাপী উৎসব। এ পর্বে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রখ্যাত কবি, আবৃত্তিশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। এরপর মঞ্চস্থ হয় শফিউল গনির গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় আবৃত্তি প্রযোজনা 'সাম্পান', স্বননের পরিবেশনায় মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোলের গ্রন্থনা ও অনন্যা লাবণী পুতুলের নির্দেশনায় 'রক্তে লেখা একাত্তর', উদীচী কেন্দ্রীয় বিভাগের প্রযোজনায় কায়েস আহমেদের গ্রন্থনা ও বেলায়েত হোসেনের নির্দেশনায় 'জয় হোক মানুষের'। একক আবৃত্তি করেন কাজী মদীনা, আহকাম উল্লাহ, লায়লা আফরোজ, রবিশঙ্কর মৈত্রী, নিরঞ্জন অধিকারী, ইকবাল খোরশেদ প্রমুখ।
উদীচীর এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিনটি সন্ধ্যা মুখর ছিল কবিতায়। দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে ছিল উদ্ভাসনের পরিবেশনায় তামান্না তীথি ও শৌনক দত্ত তনুর গ্রন্থনা এবং তামান্না তীথির নির্দেশনায় আবৃত্তি প্রযোজনা 'একাত্তরের প্রতিচ্ছবি', স্বরশ্রুতির পরিবেশনায় ও আহকাম উল্লাহর নির্দেশনায় 'আমার পরিচয়', উদীচী কেন্দ্রীয় আবৃত্তি বিভাগের পরিবেশনায় এবং বেলায়েত হোসেনের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় 'জোট বাঁধো তৈরি হও', স্বরকল্পন আবৃত্তি চক্রের প্রযোজনায় ও মোস্তাফিজ রিপনের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় 'রাজাকারের নামতা'। শেষ দিনে ছিল মোড়ক উন্মোচন পর্ব। রণেশ দাশগুপ্তের পুনর্মুদ্রিত গ্রন্থ 'আলো দিয়ে আলো জ্বালো', 'উপন্যাসের শিল্পরূপ', 'অগ্রন্থিত রণেশ দাশগুপ্ত ও ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ রচিত রণেশ দাশগুপ্তের জীবনীগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হয় অনুষ্ঠানে। এরপর ছিল বিশিষ্টজনের অংশগ্রহণে আলোচনা। সমাপনী পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন সুমা রায়, শারমিন সাথী ইসলাম, সফিউল আলম রাজা ও তিমির নন্দী।

No comments

Powered by Blogger.