জ্বালানিসংকট প্রলম্বিত হচ্ছে by অরুণ কর্মকার

বিদ্যমান জ্বালানিসংকট নিরসনে সরকারের নেওয়া সব কটি উদ্যোগের বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়েছে। ফলে জ্বালানির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যকার চলমান ঘাটতি আরও প্রলম্বিত হচ্ছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০০০ থেকে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকারের নির্লিপ্ততার কারণে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিপুল ঘাটতি দেখা দেয়। এখন দেশে দৈনিক ২৬০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট।


এই ঘাটতি পূরণ এবং ভবিষ্যতে যাতে বর্তমানের মতো সংকট সৃষ্টি না হয়, সেই লক্ষ্যে সরকার শুধু পাঁচ বছরের শাসন মেয়াদের জন্য নয়, দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানি খাত উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নেয়। তবে এর মধ্যে প্রধান কাজগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। তাই জ্বালানিসংকট আরও বেশি দিন চলার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
এলএনজি আমদানি: চট্টগ্রাম অঞ্চলের জ্বালানি ঘাটতি পূরণে সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নেয়। এ জন্য কাতার থেকে দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি আমদানির প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মহেশখালীতে ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন করে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পাইপলাইন বসিয়ে ওই গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
এই টার্মিনাল স্থাপনের জন্য প্রাক্-যোগ্য চারটি কোম্পানির সঙ্গে কয়েক দিন আগে পেট্রোবাংলার আলোচনা হয়েছে। তাতে চারটি কোম্পানিই কাজের সরকারি সূচি পরিবর্তন করে বেশি সময় চেয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, চারটি কোম্পানিই দরপ্রস্তাব দাখিল করবে। তবে সবগুলো কোম্পানিই সময় বাড়ানোর কথা বলেছে। কিছু সময় হয়তো বাড়াতেও হবে। কারণ, প্রস্তুতিপর্বে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। তবে পেট্রোবাংলা চেষ্টা করছে অন্তত ২০১৩ সালের মধ্যে কাজটি শেষ করার।
ওদিকে বঙ্গোপসাগরের সাঙ্গু ক্ষেত্রের গ্যাস উৎপাদন একবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে (এখন দৈনিক ৩০ লাখ ঘনফুট তোলা হচ্ছে)। ফলে চট্টগ্রামে জ্বালানিসংকটও বাড়ছে।
গ্যাজপ্রমের সঙ্গে চুক্তি: রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় আলোচনা চলছে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, তাদের দিয়ে দ্রুত ১০টি নতুন গ্যাসকূপ খনন করানো। ১৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে (১৯৩ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন) গ্যাজপ্রম কাজটি করবে বলে উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে। কিন্তু কূপ খনন করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্যাজপ্রম নেবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সমঝোতা হয়নি।
সরকার বলছে, কাজে ত্রুটি কিংবা অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা হলে তার দায়িত্ব গ্যাজপ্রমকে নিতে হবে। গ্যাজপ্রম বলছে, তাদের যেখানে কূপ খনন করতে বলা হবে, পেট্রোবাংলার দেওয়া তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী সেখানেই কূপ খনন করতে গিয়ে যদি দুর্ঘটনা হয়, তাহলে সেই দায়িত্ব গ্যাজপ্রম নেবে না। আর যদি গ্যাজপ্রম জরিপ করে কূপ খননের স্থান নির্ধারণ করে, সে ক্ষেত্রে তারা দুর্ঘটনার দায়ভার নেবে। বিশেষ করে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মাটি ফুঁড়ে গ্যাস উদিগরণ হচ্ছে। সেখানে কূপ খননে বিশেষ ঝুঁকি আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ বিষয়ে সমঝোতা হলে আজ-কালের মধ্যেই গ্যাজপ্রমের সঙ্গে পেট্রোবাংলার একটি চুক্তি অনুস্বাক্ষরিত হতে পারে। এরপর উভয় দেশের সরকারের শীর্ষপর্যায়ের অনুমোদন শেষে চূড়ান্ত চুক্তি হতে মার্চ পর্যন্ত গড়াতে পারে। গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ২০১১ সালের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। এখন তা মার্চ পর্যন্ত গড়ালে তারপর যন্ত্রপাতি এনে কাজ শুরু করতে বর্ষাকাল এসে যাবে। তখন কূপ খননের কাজ ব্যাহত হতে পারে।
অবশ্য পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছেন, চুক্তি অনুস্বাক্ষর হওয়ার পরই গ্যাজপ্রম যন্ত্রপাতি আনতে শুরু করবে।
পাইপলাইন: সারা দেশে সুষ্ঠুভাবে গ্যাস সরবরাহের জন্য অপরিহার্য তিনটি বড় পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্পের বাস্তবায়নও বিলম্বিত হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে বিবিয়ানা-ধনুয়া ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৩৭ কিলোমিটার লাইন। এই লাইনের জন্য পাইপ সরবরাহের একটি চুক্তি ৯ জানুয়ারি সই হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে এর অনেক কাজই এখনো বাকি। হাওরাঞ্চলসহ অনেক দুর্গম এলাকার মধ্যে এই লাইনটির নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করা খুবই কঠিন বলে ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
২০১৩ সালের মধ্যে আরও দুটি পাইপলাইন স্থাপন শেষ করার কথা। এগুলো হচ্ছে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ এবং একই ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ মহেশখালী-আনোয়ারা পাইপলাইন। এর মধ্যে তৃতীয়টি এখন পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনও পায়নি।
এসব পাইপলাইন স্থাপিত না হলে গ্যাসের উৎপাদন বাড়লেও তা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুসন্ধান: চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চারটি ভূ-কাঠামোতে গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিনোপেক সেংলি অয়েলফিল্ড সার্ভিসেসের যৌথ উদ্যোগে চুক্তি স্বাক্ষরও বিলম্বিত হচ্ছে।
ভূ-কাঠামো চারটি হচ্ছে: পটিয়া, জালদি, কাসালং ও সীতাপাহাড়। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ওই কাঠামোগুলো তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ। গত ২৭ অক্টোবর সরকার বাপেক্স-সিনোপেক যৌথ চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে। এতে বাপেক্সের ৩০ ও সিনোপেকের ৭০ শতাংশ অংশ রাখা হয়েছে।
কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তি সই হতে আরও সময় লাগবে। এ ক্ষেত্রে এখন আলোচনার মূল বিষয় হয়েছে গ্যাসের দাম। এই চুক্তি কোনো উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির (পিএসসি) অধীনে না হওয়ায় পেট্রোবাংলা বিনা মূল্যে গ্যাস পাবে না। সিনোপেকের অংশের গ্যাস আন্তর্জাতিক দরে কিনে বর্তমান সরকারি দামে বিক্রি করলে বাকি টাকার জোগান কে দেবে—এটি একটি বিষয়। বাপেক্স যে ৩০ শতাংশ গ্যাস পাবে, তা ২৫ টাকা ইউনিট দরে পেট্রোবাংলা পেলেও তা দিয়ে ঘাটতি পোষানো যাবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকারের মধ্যে কেউ কেউ ওই অঞ্চলে যৌথ উদ্যোগে গ্যাস অনুসন্ধানে রাজি নন। তাঁদের মতে, পটিয়ায় গ্যাসের কাঠামোটি আবিষ্কৃত। সেখানে বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করার কোনো অর্থ হয় না। এ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে।
কম্প্রেশার: ওপরের সবগুলো কাজ সম্পন্ন হলেও মুচাই, আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গায় তিনটি কম্প্রেশার স্থাপন ছাড়া সারা দেশে গ্যাসের সুষ্ঠু সরবরাহ অনিশ্চিতই থাকবে। এর মধ্যে মুচাইতে শেভরন যে কম্প্রেশারটি স্থাপন করছে, সেটি গত ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা শেষ হতে আগামী জুন-জুলাই লাগবে বলে জানা গেছে। আবার এই একটির কাজ শেষ হলেও লাভ হবে না। অন্য দুটির কাজ শুরুই হয়নি। কবে শুরু হবে তা-ও অনিশ্চিত।

No comments

Powered by Blogger.