নতুন গদ্য আখ্যান, বাংলাদেশে : শামীম রেজা by দেবেশ রায়

বাংলাদেশের তরুণদের গদ্যলেখা নিয়ে আমার উৎসাহ একটু বা মাত্রাহীন। তার ইঙ্গিত এটা নয় যে তরুণদের লেখা নিয়ে আমার উৎসাহ কিছু কম। বরং পক্ষপাতটা সেদিকেই বেশি_হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেনদের প্রতি আনুগত্যে। বরং, পাল্টা একটা নালিশই জমে উঠছে যে বারবার বলা সত্ত্বেও এই প্রবীণরা এই তরুণ লেখকদের পড়ছেন না। বা, এঁদের নিয়ে লিখছেন না। আবার আমাকেও তো কিছু বলছেন না, আমার ভুল হচ্ছে কোথাও।
আমি কোনো লিস্টি করতে চাই না_কোন তরুণের কোন লেখা আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। তেমন লিস্টি বানানোর যোগ্যতাই আমার নেই। আমি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও বইপত্র নিয়মিত পাই না। যেমন পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশেও তো সেই একই_নিজেদের উদ্যোগে প্রকাশিত ছোট কাগজগুলোতেই তো নতুন ভালো লেখা ছাপা হয় বেশি। বড় কাগজগুলোতেও যে হয় না, তা নয়। কিন্তু বড় হওয়াটা ভালো হওয়ার গ্যারান্টি নয়।
শামীম রেজার লেখা দুটি বই একসঙ্গে হাতে এসে পড়ায় এই সব প্রশ্নে বিহ্বল হয়ে আছি। শামীমের সঙ্গে আমার পারিবারিক মেলামেশা এতই পুরনো যে আমার হয়তো মনে মনে একটা প্রস্তুতিই তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে শামীমের কোনো নতুন লেখা কি আমার না-পড়া থাকতে পারে।
এতটা ভালোবাসা সত্ত্বেও লেখক হিসেবে শামীম আমাকে খাতির দেয়নি। একজন লেখক সম্পর্কে যদি জানতে হয়, তাহলে আমাকেই তাঁর কাছে যেতে হবে, তাঁর বই জোগাড় করতে হবে। একজন লেখককে যদি পড়তে হয়, তাহলে তাঁর লেখা জোগাড় করাও তো আমারই কাজ। সেই কাজটুকু সারা করতেই এই দেরি_ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ বেরোনো 'ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল' (প্রকাশক : সূচীপত্র) এবং ওই সময়ই বেরোনো 'ঋতুসংহারে জীবনানন্দ' (প্রকাশক : অ্যাডর্ন) আমার হাতে এল ১১-র এপ্রিলে। প্রথমটি কাব্যগ্রন্থ এবং দ্বিতীয়টি গল্পগ্রন্থ।
বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের গদ্য-আখ্যানের একটি আকার অভ্যাস করেছেন বেশ সামর্থে। পশ্চিমবঙ্গে 'ব্যক্তিগত গদ্য' নামে কখনো বা নামান্তরে এই লেখাগুলো বেরোয় কখনো কখনো, কিন্তু তেমন অনিশ্চিত 'ব্যক্তিগত'-এ বুঝতে পারি যে লেখক খানিকটা গল্প আর খানিকটা নিবন্ধের মিশেল ঘটাতে চাইছেন। কিন্তু চেষ্টার চিহ্ন লেখাটির গায়ে লেগে আছে।
বাংলাদেশে এই আকারটি এমন স্বাবলম্বিতা পেয়েছে যে গদ্য-আখ্যান বলতেই সাধ হয়। এগুলো ব্যক্তিগত নয়। 'আখ্যান' কথাটি অন্তত এটুকু আশ্বস্ত করে যে এমন লেখা কোনো ঘটনাকে অবলম্বন করে যে লেখা নয়, তা প্রায় নিশ্চিত। এগুলো ফিকশনই, কল্পনা-সক্রিয়া লেখা এবং ননফিকশন বা কল্পনা-ব্যতিরেকী নয়। কিন্তু ফিকশনের চেনা চেহারা এতে থাকে না। লেখাগুলো থেকে প্রচলিত চেহারা মুছে দেওয়ার কাজটা আমরা নিয়েছিলাম ২০ শতকের পঞ্চাশের দশকে। এত বছর পরে তো বাংলায় গদ্যের সাহিত্য রচনার হালহকিকত বদলে দেওয়ার সময়। সেই বদলই ঘটছে বাংলাদেশের এই গদ্য-আখ্যানে। বা ঘটতে পারে।
শামীমের 'ঋতুসংহারে জীবনানন্দ' এই মাত্রই_৭১ পৃষ্ঠার বইটিতে সবচেয়ে বড় লেখা 'জীবনানন্দ ও মায়াকোভস্কি জোছনা দেখতে চেয়েছিলেন; ২৪ পৃষ্ঠার, শব্দসংখ্যা ১১০০ প্রায়, আর সবচেয়ে ছোটটি 'উপনিবেশী মন' ৬ পৃষ্ঠার, শব্দসংখ্যা ২৭০০-র মতো। পৃষ্ঠাসংখ্যার এতটা অসমতা প্রচলিত একটা গল্পের বই বইতে পারত না। পারছে, এটা গদ্য-আখ্যান বলে। কিন্তু শুধু কি আয়তনের পার্থক্যই সাহিত্যের একটা আকার তৈরি করে?
সেটা তো করতেই পারে। বাংলায় ছোটগল্পের সাইজ কমতে কমতে হাজার-দুয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু এইটুকু কারণে যে খবরের কাগজের এক পাতায় ওই শব্দই আঁটে, রবিবারেও আর রবিবারের কাগজে ছাড়া গল্প ছাপা হবে কোথায়? যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্করের বেশ বড় উপন্যাসও শারদীয়তে ছাপা হয়েছে। এখন দাঁড়িয়েছে শারদীয় উপন্যাসের গড় সাইজ ২০০০০ শব্দের মতো। বিদেশি ভাষায় বই প্রকাশকরা নানা শব্দ তৈরি করে নিয়েছেন_শর্টস্টোরি, স্টোরি, লংস্টোরি, নভেলা, নভেলেট, নভেল। আমাদেরও তো বড়গল্প, ছোটগল্প, এমনকি উপন্যাসিকা আছে। ব্যবহৃতও হয়। কিন্তু বড়গল্প আর ছোট-উপন্যাসের ভেতর তফাতটা শুধুই পৃষ্ঠাসংখ্যা? কী নিয়ে লেখা, কী ধরনের লেখা, স্টাইল কী_এসব আলোচিত না হলেও বিবেচ্য উপাদান। রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গ', হেমিংওয়ের 'দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি' আর গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের 'লাভ অ্যান্ড আদার ডেমন্ডস তিনটিই উপন্যাস। ছোট-উপন্যাস নয়, বড়গল্পও নয়। পুরো উপন্যাস। প্রমাণ? এই তিনটি উপন্যাসেই পরিসর এত বিস্তারিত যে বাইরের পৃৃষ্ঠাসংখ্যা ভেতরের বিস্তারের তুলনায় তুচ্ছ হয়ে যায়।
কিন্তু শামীম রেজার এই লেখাগুলোর জন্য কেন 'গদ্য-আখ্যান' নামে নতুন পরিভাষা দরকার হচ্ছে। গল্প-উপন্যাসসংক্রান্ত ছ-ছটি পরিভাষার কোনোটি কেন ব্যবহার্য নয়। সেটি স্পষ্টতর হয় 'ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল' নামের ৬৪ পৃষ্ঠার কবিতার বইটিতে।
সূচি অনুযায়ী বইটিতে দুটি অংশ আছে। প্রথমাংশে পৃষ্ঠা দশকে আটটি লেখা। সব এক মাপের নয়। কিন্তু কোনোটাই খুব বড় বা খুব ছোট নয়। এই অংশের নাম 'দেবতা এক মুখোশের নাম'। দ্বিতীয় অংশের নাম 'ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল', ৪২ পৃষ্ঠা ধরে একটাই লেখা, এক আকারের।
বিভ্রান্তি যে কিছু ঘটে না, তা নয়। সূচিপত্রে ও নামপত্রে 'ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল' ছাপা থাকলেও সূচিপত্রে ও প্রথম রচনাটিতে একটি উপনামও আছে, 'আমাদের চোখগুলা নিয়া যারা মার্বেল খেলেছে মধ্য দুপুরে পশ্চিম পাড়ায়'। এই বিভ্রান্তিতে আপত্তি তো দূরের কথা, বরং এই বিভ্রন্তি একটা ফাঁকা তৈরি করে দেয়, বইয়ের সাবেক চেহারা ভাঙার ফাঁক। এই ফাঁকটাকেও আমি গদ্য-আখ্যানের লক্ষণ বলে ধরছি। প্রধান একটি লক্ষণ।
আমি যদি খুব বেশি বিস্মৃতিতে না ভুগি, তাহলে 'সেতুবন্ধন' কবিতায় বলেছেন শামীম, 'যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণ নগরে' লেখাটি আমার বেশ কয়েক বছর আগে পড়া। এই কবিতাটিতে বাংলাদেশের লোকমুখের ক্রিয়াপদ বা বিশেষ্যকে পশ্চিমবঙ্গের মান্য গদ্যভাষার সঙ্গে যে স্বাভাবিকতায় মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা লক্ষ করে বোধ হয় আমি একটি ছোট লেখাও লিখেছিলাম। ওই 'সেতুবন্ধন'-এর পরের গুচ্ছ তখন সংলগ্ন ছিল কি না, মনে করতে পারছি না।
এখন তো দেখতে পাচ্ছি এই গুচ্ছ-কবিতা জুড়ে নানা দেশের নানা ভাষার নানা এপিকের নানা মিথের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌখিক ক্রিয়াপদ যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান অস্তিত্বকে এতই যন্ত্রণাতুর করে দেয়।
দিগন্তের ওপর থেকে ভাইসা এল করুণ কান্নাধ্বনি...
শাখা থেকে পাতার বিচ্ছেদে কাঁইদাছিল বৃক্ষজননী_ (পৃ-৬)
এমন মৎস্যচক্ষুবেধী উপমা সম্পূর্ণতা পায় ঠিক এর পরের লেখাটিতে?

এই সেই অস্তরেখা যেখান থেকে তোমাকে তুলে নেয়া
হয়েছে...মাদী উটেদের মতো ছোট ছোট বিস্তীর্ণ পাহাড়
চারদিকে, সমাধিস্তম্ভের ভিত ফেটে যে মহীরুহ জমেছে
কী নাম দেব তার? বঙ্গবন্ধু, নাকি মানচিত্র বাংলার? (পৃ- ৭)

বাংলাদেশের সৃজ্যমান সাহিত্যের তারুণ্যের সঙ্গে আমার যতই না কেন ঘনিষ্ঠতা থাক, এ তথ্য আমার জানা নেই যে ব্যক্তিগত অনুভবের সামান্যীকরণের জীবনানন্দীয় অভ্যাস কতটা অনুসরণে আসে বাংলাদেশের তরুণদের তাঁরা যখন ওই সামান্যের বিপরীতে বিশিষ্টকে ঐতিহাসিক উল্লেখ স্থাপন করেন। কিন্তু এই শীর্ণ বইটিতে শামীম রেজার কল্পনায় বাচ্য তৈরি হচ্ছে সামান্য ও বিশেষ মেনেই_
আজও ইসকুল পালানো বালকের সিঁথিতে
কার্তিকের হাওয়া লাগা মাঠ, ছিলা হয়া হাঁটে।

এই 'ছিলা' যে ধনুকের ছিলা, তা বুঝতে অন্তত আমার সময় লেগেছে। 'হয়া' টাকে 'হয়ে লেখা ছিল স্বাভাবিক, ছন্দের একটুও ছুট হতো না। 'ছিলা'ও ছিলাই থাকত, যথাযথ। বাদ যেত শুধু এই লেখাটির নিহিত বাংলাদেশের গ্রামের কোনো বালকের শরীর-ভাসানো কার্তিকের হাওয়া_। আমার খুব লোভ হচ্ছে_বাংলাদেশের এখনকার কবিদের কিছু লেখা আতিপাতি খুঁজতে, দেখব বাংলা কবিতায় যে বাক্য জীবনানন্দীয় প্রতিমা হয়েই আছে, সেই বাক্যটিকে কর্তা-বিশেষ্য করে ফেলা হচ্ছে। ওপরের উদ্ধৃতিটিতে ব্যাকরণ-অনুযায়ী কর্তা 'মাঠ'।
জীবনানন্দকে নিয়ে দ্বিধা তো আর গেল না। তার একটি কারণ হয়তো তাঁর মৃত্যুর পরও জীবনানন্দ লিখেই চলেছেন অর্ধশতকের বেশি সময় জুড়ে। তাঁর সেই পুরনো কবিতাপুঞ্জের প্রথম পুনরুদ্ধারে পড়তে পারছি ক্রমেই, তাঁর কবিতার যে ভাষা স্বপ্নের স্বগতোক্তি মনে হতো আমাদের, সে ভাষা যুক্তির ধাপ হয়ে উঠছে ক্রমশ। কারণও একটা আছে। ইতিমধ্যে আমাদের বাংলা যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ দাঙ্গায় ভবিতব্যহীন ও বর্তমানহীন এক ভূখণ্ড হয়ে পড়ে আছে। সে এমনই কঠিন এক অস্তিত্ব, কবরের কোনো কঙ্কালের মতো, সে কঙ্কাল কিছুতেই ফসিল হচ্ছে না। জীবনানন্দের কবিতার ভাষা এর আগে কখনো এত বাস্তব হয়নি।
হয়তো এই না হওয়াটা আমাদের দুঃখ দিত, সে-ই আমাদের ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সে, কলকাতার শূন্য নাগরিক পথে হাঁটতে হাঁটতে, জীবনানন্দের কবিতার ভাষা যখন বাংলা গল্পেরও ভাষা হবে। আমরা বলতে, দীপেন, কিছুটা সন্দীপন, কিছুটা উদয়ন আর আমি। সত্যিই দীপেন এক রাতে বলেছিল, বাংলা গল্পের ভাষাই তৈরি হলো না, 'আমরা তাহলে লিখবো কবে রে?' বোধ হয়, র্যাঁ' বলেছিল।
এটা কিন্তু বেশ রহস্যময়_বাংলা গল্প-উপন্যাসের উপর জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের কোনো প্রভাব পড়ল না, কিন্তু জীবনানন্দের ভাষা তৈরি করে তুলছে বাংলার, (হ্যাঁ, অখণ্ড বাংলারই) নতুন গল্পের ভাষা। শামীমের এই বইটিতে, আগেই বলেছি, ছটি গল্প আছে। তার প্রতিটি গল্প বাংলাদেশের আগুনমুখো গল্প। বাংলাদেশ ছাড়া কোনো বিমূর্ততায় এই গল্প লেখা ঘটতেই পারত না_'বাবা সমস্ত জমি-জিরেত বেচে মারা গেছে_আমার জন্মের পর পর, আর চাচা বর্গাচাষী, এখন ভাল গৃহস্থ, মহাজন।...ততদিনে আমি কিন্তু ইউনিভার্সিটির ভাল সাবজেক্টে চান্স পেয়েছি।'
না, উদাহরণ দিচ্ছি না। আমার আন্দাজের অনুকূলে কথা বলছি। কেন, এই গল্পের লোকজন একমাত্র বাংলাদেশেই থাকতে পারে এবং এক জীবনানন্দের ভাষাতেই এদের গল্প বলা যায়। এই যে শামীম এই মানুষজনের বদলে যাওয়ার কথা বললেন, জীবনানন্দ তাঁর একটি পুরনো কবিতায় লিখে রেখেছেন_
আমরা নতুন করে পড়ছি এখন,
অনেক পুরনো দিন থেকে উঠে নতুন শহরে
আমি আজ দাঁড়ালাম এসে।
চোখের পলকে তবু বোঝা গেল জনতাগভীর তিথি আজ,
কোনো ব্যতিক্রম নেই মানুষবিশেষে।

বাংলা গল্প মোড় নিচ্ছে বাংলাদেশে। যেকোনো মোড় ফেরাতেই অনিশ্চয়তা থাকে। অনিশ্চয়তা একটাই_গন্তব্যে পেঁৗছানো গেল না, হড়কে যাওয়া হলো খাদে, উল্টো দিক থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা মারল, ধস নামল, হঠাৎ একটা বড় পাথর গড়িয়ে রাস্তা আটকে দিল। চেনা রাস্তায়ও মোড় নিতে গেলে এই সব ঘটতে পারে। অচেনা রাস্তায় তো পারেই। ফল একই। গন্তব্যে পেঁৗছানো হলো না। গন্তব্যটা কী? এই যে শামীমের লেখাগুলোতে নতুন গদ্য-আখ্যানের শক্ত, সুস্থ অঙ্কুর দেখলাম_এগুলো আর পড়া হলো না। পড়া হলো না মানে এগুলো আর বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত হলো না। ইংরেজের সঙ্গ ও শাসন আমাদের যতটা লেখক-কবি বানিয়েছে তার ভগ্নাংশ পরিমাণও পাঠক করেনি। নইলে 'গল্পগুচ্ছ'-এর গল্পগুলো যখন লেখা হয়ে গেছে, তখন প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় পাঠকপ্রিয় গল্পকার হয়ে ওঠেন? বা, 'গোরা' চতুরঙ্গ', ঘরেবাইরে' যখন লেখা হলো, তখনই শরৎচন্দ্রের ভাষায় কাশীনাথ-পরিনীতা-বিন্দুর ছেলে_এমনকি শ্রীকান্ত মার্কা নভেলগুলি বাঙালি পাঠকের হৃদয় ও মাথা জয় করে।
তদুপরি শামীম রেজার পাতলা দুটি বইয়ের কয়েকটি মাত্র লেখা নিয়ে আমার বলা কথাগুলো আমাদের কাছেও দুরূহ ঠেকছে। দুরূহতাটা কোথায় তা আমার অজানা নয়। বাংলাদেশের ছোটগল্প-উপন্যাসের সীমাসংকীর্ণতার কথা আমি তুলিনি। তুললে একটা শর্টসার্কিট ঘটে যেতে পারে, যেন সেই সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতেই এমন নতুন এক আকারের খোঁজ। আমি তেমন কোনো ঘুরপথ ভাবিনি এই নতুন গদ্য-আখ্যানের আকারটিকে যেহেতু সদর রাস্তায় মেরামতি চলছে।
বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসের জোরটা বোধ হয় এইখানে যে এমন অনেক লেখক লিখছেন, যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, ধরা যাক ১৯৬৫তে, জন্মাননি। এঁরা জন্মেইছেন স্বাধীন ও মুক্ত স্বদেশে। এখন মুক্তি যে সুযোগগুলো হাতের কাছে এনে দেয় সেই সুযোগগুলোর মধ্যে। আর যেহেতু এঁদের অখণ্ড ভারতীয় রাজনীতি বা বঙ্গীয় রাজনীতির বোঝা বইতে হয়নি, তাই স্মৃতি তাঁদের পথ আটকায়নি। মৌলবাদ, জাতিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ কতটা বেড়েছে বা বাড়েনি, সেটা হিসাবেই আনিনি এই কারণে যে সে সবই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গতিপ্রকৃতির বিষয়। ফলে বিচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা অনেক বেড়েছে, বাংলাদেশের বিশ্বভূমিকা অনেক স্পষ্ট হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি ও চিন্তাশক্তি বেড়েছে অনেক।
এই সব মিলেমিশে বাংলাদেশের তরুণ লেখকরা, এঁদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো, বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষজনকে উপকথাহীন ও ইতিহাসহীন রক্ত-মজ্জা-কঙ্কালে দেখতে শুরু করেছেন। এটা বাস্তববাদ চর্চারই রকমফের। আবার সেই কারণেই পাশ্চাত্য উপন্যাসের ইতিহাসে যাকে ন্যাচারালিজম বলা হয়, তেমন স্খলনের ভয়ও আছে। শরীরের বর্ণনায় গ্রাম ও শহরের মেয়েদের দুটো টাইপে সাজানো সেই ভয় আরো উসকে তোলে। বাংলাদেশের এই লেখকদের গল্প-উপন্যাসে মেয়েদের সর্বাধিকতম অপমান বলে ধর্ষণই ঘটে বরাবর আর অর্থ-প্রতিপত্তির বা ক্ষমতার সম্ভোগ বলে শিশু সেঙ্, ওরাল সেঙ্ ইত্যাদিই আসে এত ঘন ঘন যে এই সব ঘটনা আর ভয়ংকর থাকে না। কিন্তু ইতিমধ্যে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার উপন্যাসের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা ঘটেছে। বাংলাদেশেরও। বরং বেশি। তাতে নতুনতর নভেল-স্ট্র্যাটেজিও আমরা আন্দাজ করছি একটু-আধটু।
নতুন এই গদ্য আখ্যানগুলো বাংলাদেশের যে বাস্তবকে বিমূর্ততা দিতে চায়, সেই বিমূর্ততা পাঠক চিনতে না পারার বিপদ আছে। কিন্তু সেই বিমূর্তনের ইচ্ছাতেই তো এমন নতুন আকারের দরকার বোধ করছেন শামীম রেজা ও তাঁর সময়ের আরো কেউ কেউ। তাঁদের সংখ্যা কম। তাঁদের লেখা আরো কম। এ দুটো বাধা কাটাতে না পারলে এবং অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য না থাকলে পাঠকের মন এড়িয়ে যাবে, ভয় হয়। সে ভয় সত্ত্বেও বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস সত্যিই নতুন মোড় নিচ্ছে।

1 comment:

Powered by Blogger.