জনপ্রশাসন-পদ-পদবি আর চাকরির বয়স বর্ধন by বদিউর রহমান

চাকরির বয়স বাড়ালে কর্মদক্ষতা বাড়ে কি-না এটা প্রশ্নসাপেক্ষ। যার হয় না নয়ে, তার হবে না নব্বইয়ে, যাদের কাজের আগ্রহ নেই, সততা নেই, দেশপ্রেম নেই তাদের চাকরির বয়স দু'বছর বাড়ানোতে জনগণের সেবার কোনো হেরফের হবে না। ব্যক্তিগত লাভ দু'বছর বেশি থাকবে, অন্যদের সঙ্গে সমতা কিছুটা কাছাকাছি আসার একটা সন্তুষ্টি থাকবে মাত্র
সম্প্রতি সরকার হঠাৎ করে চাকরির বয়স অর্থাৎ অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ করেছে।


গত দু'বছর থেকে যে সিভিল সার্ভিস আইনের বিষয়ে আলোচনা, বৈঠক, জনমত যাচাই চলছিল তার কোনো সুরাহা না করে গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন, ১৯৭৪-এর সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সরকারের এ তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত রহস্যজনক হিসেবে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে শুভস্য-শীঘ্রম জাতীয় যুক্তি দেখানো হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিষয়টিকে 'জরুরি' বলে চিহ্নিত করলেও এর পেছনে গ্রহণযোগ্যতা কতখানি? বয়স বাড়ানোর দাবি অনেক পুরনো। গত কয়েক সরকারের আমলেই এ নিয়ে বেশ কথাবার্তা হয়েছে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বয়স বাড়িয়ে সবাইকে সমসুবিধা না দিয়ে পছন্দের লোকদের চুক্তি দিয়ে সরকারগুলো মুক্তি পেতে চেয়েছিল। গত জোট আমলে তো এক পর্যায়ে সচিব পদের প্রায় সবগুলো চুক্তিতে ভরে গিয়েছিল, বিশেষত পাকিস্তান আমলের তিন অস্থায়ী সাহেবদের তখন জয়জয়কার। কিন্তু চুক্তিতে মুক্তি_ এ ছিল না সঠিক যুক্তি। ফলে জোট সরকার পদোন্নতি নীতিমালায় শিথিলতা এনে '৭৭ ও '৭৯ ব্যাচের পছন্দের অনেককে সচিবও করে। তারপরও সাধারণভাবে বয়স বাড়ানোর প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। শোনা গিয়েছিল, জোট সরকার আবার ক্ষমতায় এলে নিজ পছন্দের ব্যাচকে চাকরিতে রাখার জন্য বয়স বাড়াবে। আরও শোনা গিয়েছিল, '৮১ ব্যাচ এমন চিন্তার বিপক্ষে, যাতে তাদের সচিব হওয়া বিলম্বিত না হয়। তবে নতুন নিয়োগ বাধাগ্রস্তের যুক্তি আর প্রবল থাকেনি, বয়স বাড়ানোর তাগিদ সবাই অনুভব করছিল। একই দেশের মাটিতে বড় হয়ে, কমবেশি একই ধারার মেধায় থেকে, কারও বয়স হবে ৬৭, কারও ৬৫, কারও ৬০ আর জনপ্রশাসনে মাত্র ৫৭_ এটা তো শুধু নৈতিকভাবে বৈষম্যই নয়, দক্ষতাজনিত কারণের বিশ্লেষণেও অগ্রহণযোগ্য। গড় আয়ু বর্ধন হলে তো সবারই হয়েছে, বেশি বয়সে বেশি দক্ষ হলে তা শুধু বিশেষ ক'টি ক্ষেত্রের জন্য তা হবে কেন? বৈজ্ঞানিক কোনো পরীক্ষায় তার কোনো যুক্তি যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি বাস্তবতায়ও তেমন কোনো সুফল বিশেষ পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। অতএব, জনপ্রশাসনের চাকরিওয়ালাদেরও বয়স বাড়াতে হয়। সরকারও আর চুক্তির বদনামে যেতে রাজি নয় হয়তো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সিভিল সার্ভিস আইনটি করেই তো এটা করা যেত, তাহলে সরকারের প্রশংসা বাড়ত, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৩-এর একটা বিধান অন্তত ৪০ বছর পর হলেও বাস্তবায়িত হতো। তা আর হলো না। ঠিক আছে, তারপরও গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন, ১৯৭৪-এর ধারা-৪ সংশোধন করে যদি চাকরির বয়স বাড়ানো সত্যিই জরুরি হয়ে পড়ে তাহলে সংসদে কেন এটা এলো না? সাংবিধানিক বিধানেই যেখানে এক অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিন পর পরবর্তী অধিবেশনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেখানে গত তিন বছরের এতগুলো অধিবেশনের সময়েও কি সরকার এ 'জরুরি' বিষয়টি মনে করতে পারেনি? তাছাড়া ক'দিন পরই তো আরেক অধিবেশন বসছে, তখন পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না কেন? সংসদ কার্যকর থাকা অবস্থায় অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে কার্যকর করার মতো বিষয় এটা ছিল না। তাহলে তো সন্দেহটা থেকেই যায় যে, সরকারদলীয় পছন্দের কাউকে কাউকে সুবিধা দিতেই সংসদ কার্যকর থাকা অবস্থায়ও খারাপ নজির সৃষ্টি করে, সংসদে কোনো আলোচনা ব্যতিরেকে বয়স বাড়ানোর কাজটি সেরেছে। ভালো কাজও ভালোভাবে না করলে প্রশংসনীয় কাজও 'শয়তানি'র মাধ্যমে করা হলে যেমন সমালোচনা হয়, গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন, ১৯৭৪ সংশোধন করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বয়স বাড়ানোর পন্থাটিও সে সমালোচনা থেকে মুক্ত নয়। কার চাপে, কোন চাপে শেখ হাসিনার সরকার এ সহজ কাজটিও জটিল করে সংসদকে পাশ কাটিয়ে করে ফেলল তা আজ অজানা থেকে গেল।
চাকরির বয়স বাড়ালে কর্মদক্ষতা বাড়ে কি-না এটা প্রশ্নসাপেক্ষ। যার হয় না নয়ে, তার হবে না নব্বইয়ে, যাদের কাজের আগ্রহ নেই, সততা নেই, দেশপ্রেম নেই তাদের চাকরির বয়স দু'বছর বাড়ানোতে জনগণের সেবার কোনো হেরফের হবে না। ব্যক্তিগত লাভ দু'বছর বেশি থাকবে, অন্যদের সঙ্গে সমতা কিছুটা কাছাকাছি আসার একটা সন্তুষ্টি থাকবে মাত্র। আর সরকার যদি মনে করে, চুক্তি ছাড়া তার পছন্দের কর্তাদের নির্বিঘ্নে রাখা গেল, তবে ভালো। তারপরও স্বীকার করতে হয়, জনপ্রশাসনে এটা কাম্য ছিল, প্রত্যাশিত ছিল। এটা বিজয় দিবসের কোনো উপহার হতে পারে না। কোনো বিতর্কিত-সমালোচিত উপদেষ্টার ফাও কথা অপ্রত্যাশিত। এবার সরকার জ্যেষ্ঠ সচিবের আট পদ সৃষ্টি করেছে। এটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। সচিব তো সচিবই, তাদের জ্যেষ্ঠতা তো গ্রেডেশন তালিকা অনুযায়ী নির্ধারিত আছেই। হ্যাঁ, বেতনের সম্মান বেশি দেওয়ার জন্য যদি এটা করা হয়ে থাকে তবে আট কেন, দশ বা পনের নয় কেন? আর শুধু জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই যদি জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়ে থাকে তবে ক'বছর সচিব থাকলে একজন সচিব জ্যেষ্ঠ সচিব হবেন তা নির্ধারণ করা হয়েছে কি-না আমি এখনও জানতে পারিনি। এ পদক্ষেপ কি সচিবদের অন্য কোনো সার্ভিসের কারও মর্যাদা নিয়ে মনস্তাত্তি্বক প্রশান্তি দেওয়ার আরেক প্রচেষ্টা? দৈনিক ইত্তেফাকের ১০ জানুয়ারি, ২০১১ সালের এ সংক্রান্ত সংবাদের ক্যাপশন বড় দুঃখজনক_ 'জনপ্রশাসনে লে. জেনারেল মর্যাদায় আট সচিব, জেনারেল মর্যাদায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব।' সিভিল সার্ভিস কেন সামরিক সার্ভিসের সঙ্গে এমন মর্যাদার বিতর্কে যাবে? ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স রাষ্ট্রীয় আচারের একটা অনুসরণীয় পদ্ধতি মাত্র, তা কোনোক্রমেই আন্তঃসার্ভিস মর্যাদা নির্ধারণের মাপকাঠি নয়, যেমন নয় বেতন স্কেলও। আগে মেজর জেনারেল যুগ্ম সচিবের মর্যাদায় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ছিল কি ছিল না সেটা বড় কথা নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একটা মানদণ্ড অনুসৃত হয়ে আসছে। সামরিক বাহিনীর অনেককে সিভিল পদে আনা হয়, কিন্তু সিভিল পদের ক'জনকে সামরিক পদে নেওয়া হয়? অতএব যার যার মর্যাদা তার তার, তার তার সার্ভিসে। আদালতের এক রায়ে জেলা জজদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের মর্যাদা নির্ধারণ নিয়ে সরকার বিপাকে আছে, এখন আবার কে কার সমান হলো তা নতুন বিতর্কের সৃষ্টি না করলেই হয়। আমি বলি, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সার্ভিসভিত্তিক, পেশাভিত্তিক অনেক লাইন থাকলে যার যার শ্রেণীর লাইনে তার জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ বসবেন, অতএব আন্তঃসার্ভিস-চাকরি-পেশা জ্যেষ্ঠতার লড়াই আর থাকল না। ভালো কথা, পদ-পদায়নের অসুবিধা বিবেচনায় সরকার প্রত্যেক সোপানেই চাকরির মেয়াদভিত্তিক এমন ব্যবস্থা নিতে পারে, যেমন জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত সচিব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সচিব, জ্যেষ্ঠ উপসচিব। সহকারী সচিবের পর সিনিয়র সহকারী সচিব পদ তো রয়েছেই, সেখানেও জ্যেষ্ঠ সিনিয়র সহকারী সচিব পদ সৃষ্টি করলে উপসচিব পদে বিলম্বিত পদোন্নতির সান্ত্বনা কিছুটা হবে বৈকি!
থ্রি স্টার জেনারেলের মর্যাদা পাবেন পুলিশের আইজি, নিজের মর্যাদা ফেরত পেলেন তিনি। এরশাদ সামরিক আইনের আমলে আইজিপিকে খাটো করেছিলেন, এটা প্রত্যাশিত ছিল না। এটা যেমন খারাপ করেছেন এরশাদ, তেমনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক এসপির এসিআর লেখা বন্ধ করাও ঠিক হয়নি, যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। প্রশাসনকে খুশি করতে যদি আট সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করা যায় তাহলে পুলিশকে খুশি করতে সচিব মর্যাদায় পাঁচ আইজির পদ সৃষ্টি বরং উভয়দিক ব্যালেন্স করার প্রচেষ্টাই বলতে হয়। জবাবদিহিতা এবং গুণগত মানের নিশ্চয়তার মনিটরিং সুনিশ্চিত করতে না পারলে এসব সস্তা 'উপহারে' কোনো কাজ হবে না কিন্তু।

বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান
এনবিআর

No comments

Powered by Blogger.