পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? by আমিরুল আলম খান

'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?' প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী বঙ্কিমচন্দ্রের এই বাক্য ধার করিয়া লেখা শুরু করিলাম। কেননা, আদিকাল হইতে ভনিতায় গুরুর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রীতি। বাংলাদেশে শিক্ষা পথ হারাইয়াছে- এমন অধর্ম কথা দুঃশীল ছাড়া কে কহিতে পারে? কোন গহন বনে সে পথ হারাইয়াছে, কোন প্রবল ঝঞ্ঝাবাত্যা তাহাকে অকূল সাগরে নিক্ষেপ করিয়াছে, তাহা বুঝিয়া ওঠা আমাদের দুঃসাধ্য বটে। তাই এই রূপ ধারণা আমরা প্রথমেই নাকচ করিতে চাই। ২০১৮ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা আজ শেষ হইল। বলাই বাহুল্য, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তাহা এক অনন্য কীর্তি হইয়া রহিল। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাহা লিখিত হইতে পারে। কেননা, এবার এমন একটি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় নাই, যাহার প্রশ্ন ফাঁস না হইয়াছে। তাহার চেয়ে আরও দুঃখের কাহিনী হইল, স্বয়ং সেনাপতি রণে ভঙ্গ দিয়া যুদ্ধের আগেই পরাজয় মানিয়া লইয়াছেন এবং সগর্বে ঘোষণা করিয়াছেন- প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করিবার সাধ্য তাহাদের নাই। পলাশীর প্রান্তরে নবাবের প্রধান সেনাপতি জাফর আলী খাঁর মতোই মহাসেনাধ্যক্ষ অস্ত্র সংবরণ করিয়া পরাজয় নিশ্চিত করিয়াছেন। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হইতে পারেন। তবে চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোর-কিশোরীদের গরাদে পাঠাইতে কেহ কসুর করে নাই। তাহাদের অপরাধ, তাহাদের স্মার্টফোনে কে বা কাহারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাঠাইয়াছিল। কাহারা পাঠাইল, কোথা হইতে পাঠাইল, কেমন করিয়া তাহারা প্রশ্ন সংগ্রহ করিয়া ফাঁস করিল, তাহা জানা গেল না। তাই দুর্বৃত্তরা ধরাছোঁয়ার বাহিরেই রহিল; কিন্তু অবুঝ শিশুরা জীবনের প্রথমেই লৌহকারার অন্তরালে বন্দি হইল। সংবিধানে শিশুদের যে অধিকার দেওয়া হইয়াছে, তাহা ডোবা পুকুরে ডুবিয়া গেল। এহেন আইন প্রয়োগে স্বর্গলোকে এখন বাংলাদেশের বিশেষ সমাদার হইবে, তাহা নিশ্চিত। জাতি এখন তথ্য জানার অধিকারী। দেশে তথ্য অধিকার আইন পাস হইয়াছে এবং একজন তথ্য আধিকারিক সমহিমায় গদিনশিন। তাহা হইলে কী হইবে, কোন অর্বাচীন অভিন্ন প্রশ্নে মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দিয়াছিলেন, সেই মহাপণ্ডিতের নাম জাতি অদ্যাবধি জানিতে পারে নাই। জানিতে পারিলে তাহাকে আমরা সংবর্ধনা দিতে পারিতাম; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কোনো পদকে ভূষিত করিতে পারিতাম। কেননা, তাহার মস্তিস্কজাত পরামর্শে এবার সাড়ে ২২ লক্ষ কিশোর-কিশোরী পরীক্ষা নামক প্রহসনে নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করিল, তাহারা সারা জীবন এই তকমা বহন করিবে যে, ২০১৮ সালে বাংলা মুলুকে পরীক্ষা নামক যে প্রহসন মঞ্চস্থ হইয়াছিল, তাহারাই ছিল তাহার আসল কুশীলব। আমাদের শিক্ষা সচিব অতীব ভদ্রলোক। পরীক্ষায় এমন অভিনব বিপর্যয়ে অনেকেই এমন মন্তব্য করিয়াছেন যাহা তাহার মনোপীড়ার কারণ হইয়াছে। তিনি খেদের সহিত তাহা বলিয়াছেন এবং দেশের মিডিয়া তাহা প্রকাশ করিয়া তাহার মর্মপীড়ার খবরটি দেশবাসীকে জানাইতে ভুল করে নাই। আমরা অক্ষম ব্যক্তি। মান্যবর সচিবের প্রতি শুকনা সহানুভূতি প্রকাশ ছাড়া আর কীবা করিতে পারি! তবে আমরা আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা লইয়া আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত; যাহার আংশিক মাত্র মিডিয়া ফাঁস করিয়াছে, তাহা জানিয়া ধন্য হইলাম। জানিতে পারিলাম, আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এমন এক নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা তাহারা আবিস্কার করিয়াছেন, যেখানে লখিন্দরের বাসরঘরে সর্প অনুপ্রবেশের অণু পরিমাণ কোনো ছিদ্রই থাকিবে না এবং তজ্জন্য লখিন্দর নিরাপদে বাসর উপভোগ করিবে। তাহার পর্যায়গুলি জানিলে দেশবাসী 'মারহাবা, মারহাবা' রবে চারিদিক উচ্চকিত করিবে, তাহাতে আমরাও নিঃসন্দেহ হইয়াছি। প্রশ্ন ফাঁস রোধে অন্তত চারি পর্বের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছে, যাহা মিডিয়া ফাঁস করিয়াছে।
পর্ব-১. শতাধিক প্রশ্নের ব্যাংক হইতে বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করিয়া পরীক্ষার দিন সকালে র‌্যান্ডম প্রথা অবলম্বনে মাত্র অর্ধ ঘণ্টায় প্রশ্ন তৈরি করা হইবে।
পর্ব-২. পরীক্ষার অর্ধঘণ্টা পূর্বে তাহা কেন্দ্রে অনলাইনে পাঠানো হইবে। তাহার পূর্বেই অবশ্য হলে পরীক্ষার্থীরা আসন লইবে। সুতরাং প্রশ্ন ফাঁস হইলেও তাহাতে কোনো সুবিধা কেহ পাইবে না।
পর্ব-৩. কেন্দ্র অধিকর্তা সেই প্রশ্ন ডাউনলোড করিবেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক তাহা ব্ল্যাকবোর্ডে লিখিয়া দিবেন।
পর্ব-৪. ব্ল্যাকবোর্ডে উৎকীর্ণ প্রশ্ন পড়িয়া পরীক্ষার্থীগণ পরম আহদ্মাদে উত্তর লিখিয়া আসিবে। ইহাতে বঙ্গাল মুলুক প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘোরতর সমস্যা হইতে নিজেকে মুক্ত করিবে। এই গায়েবি আবিস্কারের কথা পাঠ করিয়া এক অধম লিখিয়াছে, তাহাতে পরীক্ষার নামে পরীক্ষারই অপমৃত্যু নিশ্চিত হইবে। আমরা আদার বেপারী, জাহাজের খবর জানিয়া কী লাভ? পরীক্ষা লইয়া এ দেশে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হইতেছে, দুনিয়ার কোথাও তাহা বে-নজির। দেশের সুউচ্চ মহলে যাহারা বাস করেন, যাহারা আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান, তাহারা ভাবিয়া চিন্তিয়া যাহা আবিস্কার করিয়াছেন তাহা নিতান্ত মাকাল ফল হইবে- এমত সন্দেহ যাহারা পোষণ করেন তাহাদের মনে কুমতলব থাকাই সম্ভব। তবে শুনিতে পাই, গ্যাজেট বেপারীরা আনন্দে গোঁফে তা দিতেছেন, মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তাহাদের নাকি বিরাট বাণিজ্য সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। সকলেই মানিবেন, বাণিজ্য যত প্রসারিত হইবে, দেশও তত শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করিবে, জাতি দ্রুত উন্নত ও ধনী হইবে। তবে দেশে নিন্দুকের অভাব নাই। বেতমিজরা কহিতেছেন, এই নিদানে সবই হাসিল হইবে, কেবলমাত্র পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়া। আর এই তত্ত্ব যাহারা আবিস্কার করিয়াছেন তাহারা নাকি পাবনার হেমায়েতপুরের সল্ফ্ভ্রান্ত বাসিন্দা। সুতরাং সুফল মিলিবেই। বহুকাল পূর্বে কেহ নাকি বলিয়াছিলেন, শিক্ষায় যেদিন আমলা-কেরানিরা সুদৃশ্য নাসিকা গলাইতে শুরু করিয়াছে, সেই দিন হইতে লজ্জায়, ঘৃণায় এ দেশ হইতে বিদ্যাদেবী বিদায় লইয়াছেন। তাহারা বলেন, কাজটি গুরুদের উপর ছাড়িলে অনর্থ কম হইত। কিন্তু গুরুদের উপর মহাপ্রতাপশালীদের আস্থা নাই। তাই গুরুদের শিক্ষা হইতে যত দূরে রাখা যায়, ততই জাতির মঙ্গল! আমরা বিনীতভাবে একটি ছোট্ট আবদার রাখিতে চাই- লেখাপড়া, পরীক্ষা ইত্যাদি কর্ম হইতে শিক্ষকদের দূরে রাখুন, দেশের একমাত্র সৎ প্রাণী আমলা-কেরানিদের উপর বিদ্যার সকল ভার অর্পণ করুন। বিদ্যাদেবী নিজেই মুক্তি পাইবেন।
amirulkhan7@gmail.com
সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড

No comments

Powered by Blogger.