অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক মূল লক্ষ্য by আবদুল লতিফ মন্ডল

১৯ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে, তাহলে কিছু করার নেই। নির্বাচন সময়মতোই হবে। ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর ইতালি সফর সম্পর্কে জানাতে মূলত সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হলেও আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হওয়া, ওই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা না করা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হওয়া, কারাগারে তাকে সুবিধাদি প্রদান করা এবং বিএনপির গঠনতন্ত্রের একটি ধারা পরিবর্তন করে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে। বিএনপি আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না- দলটির এমন অবস্থানের কথা সাম্প্রতিক সময়ে হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। বরং গত কয়েক মাসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও অন্য সিনিয়র নেতারা আগামী সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের কথা জানিয়েছেন। গত নভেম্বরের শেষদিকে একটি গুঞ্জন ওঠে, একাদশ সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসতে পারে। পহেলা ডিসেম্বর রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন- সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে যে কোনো সময় নির্বাচন দিলে বিএনপি তাতে অংশগ্রহণ করবে। এরপর ২ জানুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পরও বিএনপির যৌথ নেতৃত্ব আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে ১৯ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া দেশে কারও কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
এতে খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়া বোঝায় না। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের জন্য সরকারের কাছে মূলত দুটি দাবি জানানো হচ্ছে; একটি হল- সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা, অন্যটি নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সরকার পদত্যাগ করলে ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি উপনির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এ দাবিতে আওয়ামী লীগ সংসদ বর্জন ও সংসদ থেকে পদত্যাগ ছাড়াও ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে। আওয়ামী লীগের সংসদ বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতির শুরু। বিএনপি সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় সরকার সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বর্জিত নির্বাচনে কেবল বিএনপি সদস্যদের দ্বারা গঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ওই বছর মার্চে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। এটি অনস্বীকার্য যে, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জনগণের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি এরশাদ নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং ৫ বছর দেশ শাসনের আইনসঙ্গত অধিকার থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে বিএনপির সরে দাঁড়ানো দেশের এযাবৎকালের রাজনীতিতে দুটি উজ্জ্বল ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তারা বিএনপির শাসনামলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল, ক্ষমতায় এসে তারাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সহযোগী ১৮টি দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেকটা এককভাবে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আবারও ক্ষমতায় আসে। এতে দেশে গণতন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া এখন আর শুধু বিএনপির দাবি নয়; এটি সব বিরোধী দলের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের বিতর্কিত বিধান প্রবর্তন করে। এতে বলা হয়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে আরও বিধান করা হয়, সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকালে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। গত বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংসদ ভেঙে দিয়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। তারা যুক্তি দেখান-সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে এমন দেশগুলোয় জাতীয় সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের বিধান নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হয়ে বাংলাদেশ এমন কিছু করতে পারে না, যা বিশ্বে প্রচলিত সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে বেমানান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি সহিংস আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়নি; বরং দলটির নেতৃত্ব সম্মিলিতভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও আইনি পথে হাঁটছে। এজন্য দলটি ইতিমধ্যে দেশে ও বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সরকারের উসকানি ও হার্ডলাইনে যাওয়া সত্ত্বেও বিএনপি এ অবস্থান ধরে রাখতে পারলে তা আগামী নির্বাচনে তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে বলে অনেকে মনে করছেন। দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চায়, আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হোক। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো এ প্রশ্নে একমত। চলতি মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সফরে এসেছিল আট সদস্যের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল। সফরকালে দলটির নেতা জ্যঁ ল্যামবার্ট বলেছেন- বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ইইউ। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ডি ওয়াটকিনস বলেছেন- জাতিসংঘ বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট চলতি সপ্তাহে বলেছেন- যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। তিনি এমন সময় এ মন্তব্য করলেন, যখন দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের স্বার্থে সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়াসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা হতে হবে। এজন্য তাদের আলোচনায় বসার বিকল্প নেই। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এজন্য সরকারকে যেমন বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় না বসার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে, তেমনি বিএনপিকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে অনেকটা ছাড় দিতে হবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে দলীয় সরকারগুলোর অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলোয় ক্ষমতায় থাকা দলীয় সরকারের হস্তক্ষেপ, কারচুপিসহ বিভিন্ন অনিয়মের যেসব নজির রয়েছে, তাতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি জনগণের সমর্থন পাবে বলে অনেকের বিশ্বাস। দশম সংসদ নির্বাচন একদলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র যেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত গণতন্ত্র সুস্থ ও সবল হয়ে উঠুক, এটাই প্রত্যাশা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.