গুজবে কান দেবেন না... by মাকিদ হায়দার

অনেকেই বলে থাকেন গুজবের হাত-পা, কান বলে কিছুই নেই। ১৯৬৫ সালে শুনেছিলাম, পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতের হাজার হাজার সৈনিক হত্যা করেছে। অনেক যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। পাকিস্তানের সৈনিকরা যে কোনো সময় দিল্লি দখল করে নেবে। চা-পান শেষে দিল্লির জামে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করবে। তারপর সমগ্র ভারতকে পাকিস্তান বানানো হবে। পরে শুনেছি, সেটি ছিল গুজব। এটি ছিল মনোবল বাড়ানোর কৌশল। অথচ সেই যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল পাকিস্তান। ১৯৬৯ সালে শুনেছিলাম, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনয়েম খানের কাছে রাওয়ালপিন্ডি থেকে আইয়ুব খানের কোনো টেলিফোন এলেই গভর্নর মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে নাকি বলতেন, জি আব্বা হুজুর, জি আব্বা। যতক্ষণ প্রেসিডেন্ট সাহেবের কথা শেষ না হতো ততক্ষণ পর্যন্ত গভর্নর সাহেব চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গভর্নর মোনয়েমকে নিয়ে হাজার রকমের গুজবের ভেতরে আরও ছিল, তিনি কবি জসিমউদ্‌দীনকে নাকি বলেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনা করতে। গুজবের হাত-পা থাকুক বা না-ই থাকুক, ভাসতে ভাসতেই পৌঁছে যায় হাজার মানুষের কানে। অপরদিকে গুজবের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকে দেয়াল লিখন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের আগে শহরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দেয়ালে বিশাল বিশাল হরফে লেখা হয়েছিল- 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই'। কোথাও কোথাও লেখা হয়েছিল চীনের মহান নেতা মাও সে তুং-এর মহান বাণী- (ক) শ্রেণিশত্রু খতম কর, (খ) বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস। গত শতকের আশির দশকে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেট পার হতেই হাতের বাঁদিকের বাড়ির একটির দেয়ালে লেখা ছিল- 'এরশাদের চরিত্র/ফুলের মতো পবিত্র।' হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন দেশের রাষ্ট্রপতি এবং গণমানুষের আলোচনার মধ্যমণি। দুর্মুখ, দুর্বৃত্তরা বলেছিল, দেয়ালের ওই অমৃত বাণী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরই রচিত; তিনি কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। মগবাজার থেকে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তায় আসতে হাতের ডানদিকের একটি দেয়ালে লেখা দেখলাম, যা দেখে আকৃষ্ট হলাম- 'কষ্টে আছে আইজুদ্দীন'। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর অনেক রকম গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা শেষে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এমনকি এই দশকের গোড়ার দিক থেকেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাড়ির দেয়ালে কে বা কারা লিখেছিলেন- শেখ মুজিব হত্যার বিচার চাই। দেয়াল লিখনটি দেখার পর হঠাৎ অতীতে ফিরে গেলাম। সেটি ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি কলেজে পড়লেও মালিবাগ থেকে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম ইকবাল হলে, আড্ডা দিতে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। হঠাৎ একদিন শেখ শহীদুল ইসলাম ভাই ইকবাল হল থেকে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে তার মামার বাড়িতে গেলেন। এমনকি রিকশা ভাড়া 'আট আনা' দিয়ে আমাকে জানালেন, মামার সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেব। যথারীতি বাইরের ঘরের লম্বা চৌকি/বেঞ্চের ওপরে বসতে না বসতেই শেখ মুজিব নেমে এলেন দোতলা থেকে। দেখলাম লম্বা, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, লুঙ্গি পরনে; হাত পাইপ। একবার তাকালেন শেখ শহীদের দিকে, পরে আমার দিকে। শহীদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন- ছেলেটি কে? শহীদ ভাই জানালেন, জগন্নাথ কলেজে পড়ে; ছাত্রলীগের তরুণ... কথাটি সম্পন্ন করতে পারলেন না শেখ শহীদ। তখনই তার মামা আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, রাজী উদ্দিন রাজুকে চিনিস নাকি? বললাম হ্যাঁ। রাজু ভাই তো আমাদের নেতা।
জগন্নাথ কলেজের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি। শেখ সাহেব বোধ করি আমার কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন। সৌভাগ্যক্রমে শহীদ ভাইয়ের মামী, তিনিও এসে উপস্থিত এবং কাকে যেন বললেন, কবুতরের খাবার-পানি ঠিকমতো দিস। শেখ মুজিব বললেন, টুঙ্গিপাড়া থেকে গতকাল যে খেজুরের গুড়, পাটালি আর মুড়ি এসেছে, ওদের খেতে দাও রেনু। সেই আমি প্রথম বেগম মুজিবের নাম শুনলাম। যথারীতি গুড়-মুড়ি আসার আগে শেখ সাহেব বললেন, বাড়ি কোথায়? বললাম, পাবনায়। তিনি শেষ শব্দটি বলেছিলেন- পড়ালেখা ভালো করে করবি। সেই কথাটি এখনও আমাকে দোলায়িত করে। বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। তাই স্মৃতি খুবই নির্মম। দীর্ঘ ৫৩ বছর এই ঢাকা শহরে বাস করে অনেক দেয়াল লিখন দেখলাম এবং পড়লাম, গুজব শুনলাম সহস্রাধিক। দেয়াল লিখন ও গুজবের মাঝে পার্থক্যটি হলো- দেয়াল লিখন মানুষের দৃষ্টিতে দীর্ঘদিন দৃশ্যমান, গুজব ভাসমান। ১৯৭৩-৭৪ সালে ডাকসুর বার্ষিক নাটকে শেখ কামাল অভিনয় করেছিলেন। আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় অভিনয় করেছিলেন রেখা আহমেদ, খায়রুল আলম সবুজ। ম. হামিদ নাট্যচক্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং ডাকসুর অন্যতম নেতা। শেখ কামালের কণ্ঠে গান শুনেছিলাম। তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে গেয়েছিলেন সত্তরের দশকের একটি জনপ্রিয় গান- 'চালে ডালে মিশাইলি রে'। বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকে তাকে দেখেছিলাম। সম্ভবত তিনি অভিনয় করেছিলেন এবং ছাত্র ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের। সেই কামালকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল কতিপয় বিভ্রান্ত সৈনিকের হাতে। এখন একটি গুজব ও সত্য ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। জানুয়ারি, ১৯৭৬ সালের শীতসন্ধ্যায় রূপকথা সিনেমা হলের মালিক মোবারক হোসেন রত্ন, আমি, বলাকার শহীদুল্লাহসহ আড্ডা যখন তুঙ্গে, শহীদুল্লাহ বললেন- চলেন যাই আমিন উদ্দীন পার্কে। দু'জনে রিকশায় চেপে গিয়ে পৌঁছালাম যাত্রার মাঠে। রাত তখন প্রায় ১০টা। লোকে লোকারণ্য। মাইকে ভেসে আসছে- আজকের যাত্রার বিশেষ আকর্ষণ বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী প্রিন্সেস আলেয়ার সঙ্গে নাচবেন ১২ জন ডানাকাটা পরী। ঠিক রাত ১২টা বাজার ১৫ মিনিট আগে ঢোল-ডগর, কাঁসর-সানাই বাজতে শুরু করল। সেইসঙ্গে ১২টি ডানাকাটা পরীসহ প্রিন্সেস আলেয়ার উদ্দাম নৃত্য। ১২টা বাজতেই শুরু হলো 'ঘরজামাই' যাত্রা। তখনই আমার পাশে এসে বসলেন পাবনা সদর থানার এক সাব ইন্সপেক্টর। বারকয়েক আমার চেহারা ভালো করে লক্ষ্য করলেন। তারপর আমার নাম, ঢাকায় কোথায় কী করি-না করি। তারপর হঠাৎ চলে গেলেন। রাত গভীর হতেই শহীদুল্লাহ বললেন, মা আমার জন্য জেগে আছেন, আর যাত্রা দেখব না। আমরা ঘুমাতে গিয়েছি। হঠাৎ চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। সেই ফাঁকে শহীদুল্লাহ অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন একদল পুলিশ আর মিলিটারির চোখ ফাঁকি দিয়ে। ঘুম জড়ানো চোখে দেখলাম, আর্মির একজন ক্যাপ্টেনসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ। শুনলাম, 'শালাকে এতদিনে পেয়েছি।' যাত্রা দেখতে গিয়ে যে সাব ইন্সপেক্টর আমার যাবতীয় তথ্য নিয়েছিলেন, তিনিও আছেন ওই দলে। তিনি কাকে যেন বললেন, আপনার কথাই ঠিক। চুল, গোঁফ, চেহারায় মিলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে বেঁধে তুলে ফেললেন জিপে। এমন সময় ফজরের আজান পড়ল, আমি কিছুই বুঝলাম না। জিপ গিয়ে পৌঁছাল নূরপুরের আর্মি ক্যাম্পে। আমার শরীরে ফুলহাতা শার্ট আর লুঙ্গি। ঘণ্টা তিন-চার পরে তৎকালীন (১৯৭৬) পাবনার ডিসিএমএলএ সাহেব এলেন। সঙ্গে একজন তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট। আসামি হিসেবে আমাকে ডাকা হলো। ডিসিএমএলএ সাহেবের কক্ষে ঢুকতেই সেই তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন- আরে মাকিদ ভাই! তখনই ডিসিএমএলএ সাহেব তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, উনাকে কি আপনি চেনেন? ডিসিএমএলএ কী ভেবে সেন্ট্রিকে ডেকে পাঠালেন। ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, সোর্সকে ধরে হাজতে পাঠিয়ে দাও ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য। নূরপুরের আর্মি ক্যাম্প থেকে প্রায় দৌড়ে চলে এলাম দোহারপাড়ায়। দিনকয়েক আর শহরে যাইনি ভয়ে। শহীদুল্লাহ নিজেই একদিন দোহারপাড়ায় এসে জানালেন আমাকে এক চমকপ্রদ খবর। আমি আর আমার ছোট ভাই হাবীবুল্লাহ নাকি কুষ্টিয়ায় মিলিটারিদের ওপর বোমা মেরেছি। গাড়ি হাইজ্যাক করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ভারতে। দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও চমকপ্রদ, হাস্যকর এবং ভীষণ মজার। পুলিশের সেই এসআই এবং তাদের এক সোর্স ভেবেছিল, আপনি শেখ কামাল। আপনাকে দেখতেও কামালের মতোই। পাতলা, লম্বা; উচ্চতা ছয় ফুট। ইতিপূর্বে সমগ্র বাংলাদেশে একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল- ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডে জাতির পিতাসহ পরিবারের সবাই নিহত হলেও কর্নেল ফারুক, রশীদ এবং অন্য খুনিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেখ কামাল বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গোপন সূত্রে পুলিশ জেনেছিল, কামাল ভারতে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে পাবনায় এসেছেন। ক্যাপ্টেন লিয়াকত যখন নিশ্চিত হলেন, আমি শেখ কামাল নই, তখনই নিস্কৃতি মিলল সেই ভয়াবহ সময়ের কালে। শহীদুল্লাহ ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে জানিয়েছিলেন, চেহারায় মিল থাকলে বিপদ কীভাবে ঘনিয়ে আসে- তার জ্বলন্ত প্রমাণ আপনি। আজকাল প্রায় একই রকম ঝামেলায় পড়তে হয়। বিশেষত একুশের বইমেলায় এবং ঢাকার বাইরে শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠানে গেলে। অনেকেই ভাবেন, আমি বোধ হয় জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমাকে নাকি দেখতে জাফরের মতো সাদা চুল, গোঁফ লম্বা, কালার প্রিন্টেড শার্ট সবকিছু মিলিয়ে। তরুণ-তরুণীরা জাফর ভেবে তার সদ্য প্রকাশিত বই নিয়ে স্বাক্ষরপ্রাপ্তির আশায় এলে বুঝিয়ে বলি, আমি তিনি নই। রবিঠাকুরের সেই কথায় আবার ফিরে আসি- 'পুরানো স্মৃতিগুলো মদের মতো'। দেয়াল লিখন পড়বেন, তবে গুজবে কান দেবেন না। দিলে নিজের কান দুটো হারাতে হবে। অথবা চিলও নিয়ে যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.