জননিরাপত্তা ও রাজনীতি by এ এম এম শওকত আলী

ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ একটি দৈনিকে সম্পাদকীয় মন্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল খুন-খারাবি বৃদ্ধি। এ মন্তব্যে একাধিক খুনের ঘটনার বিবরণ দেখা যায়। এ কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর প্রারম্ভিক মন্তব্য ছিল- 'নির্বাচনের বছরে এমনিতেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা নাজুক থাকে। তাই বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে, দিন যত যাবে, রাজনৈতিক উত্তাপ তত ছড়াবে।' এ ধরনের মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই। সাবেক প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার দণ্ডাদেশের পর চলমান ঘটনাপ্রবাহের আলোকে বিচার করলে বলা যায়, জননিরাপত্তা বিধানের কর্মকাণ্ডে ব্যক্তি নিরাপত্তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর কিছু প্রমাণ গত ৮ ফেব্রুয়ারি একই দৈনিকে পাওয়া যায়। এ সংবাদের শিরোনাম ছিল- 'বিশেষ অভিযানে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য'। কারণ, নিরপরাধ লোকজন হয়রানির শিকার হয়েছে। উৎকোচ আদায়ের অভিযোগের কিছু ঘটনাও এ সংবাদে প্রকাশ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় দশ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। এ সংবাদের প্রতিবেদক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের মন্তব্যও এ ক্ষেত্রে প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে একজন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যজন গণগ্রেফতারের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। আলোচ্য প্রতিবেদনের সঙ্গে মধুবাগের একটি পরিবারের ছবিও দৃশ্যমান ছিল। একজন শিশুসহ এ পরিবারের তিনজন নারী সদস্যের দৃশ্য এ ছবিতে প্রতিফলিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে দিনভর সংশ্নিষ্ট নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজে তারা রমনা থানার সামনে বসেছিলেন। অথচ থানার পক্ষ থেকে এদের সহায়তা দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। ঢাকা মহানগরের প্রায় প্রতিটি থানাই এখন মডেল থানা বলে দাবি করা হয়। প্রায় সব থানায় 'ভিকটিম সহায়তা কেন্দ্রের' সাইনবোর্ড দৃশ্যমান। পুলিশি সংস্কৃতিতে সারাদিন থানার সামনে বসে থাকা শিশু ও নারীরা 'ভিকটিম' নন। প্রকৃত অর্থে তারাও 'ভিকটিম'। কারণ সংশ্নিষ্ট নারীর স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। 'ভিকটিম' বলে বিবেচিত না হলেও এক অর্থে তারা পুলিশের বিশেষ অভিযানের পরোক্ষ 'ভিকটিম'। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থা যে নাগরিক, বিশেষ করে দারিদ্র্যবান্ধব নয়, তা অতীতের কিছু গবেষণায় এক দশকের আগেই প্রকাশ করা হয়েছে। এরপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
গণগ্রেফতারের নিরপরাধ কিছু 'ভিকটিম' সম্পর্কে ১১ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এ সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপির প্রতিবাদ মিছিল ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর ডিএনসিসির বৈদ্যুতিক বিভাগের এক কর্মচারীকে বিজয়নগর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যক্তির আকুতিপূর্ণ ছবিও ওই দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। তার হাতে ডিএনসিসির পরিচয়পত্রটিও দৃশ্যমান ছিল। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সহকর্মীদের মতে, সংসার চালানোর জন্য ডিএনসিসির ওই কর্মচারী খণ্ডকালীন হকারের কাজও করেন। ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় এ পর্যন্ত কতজন ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে তার সার্বিক কোনো পরিসংখ্যান অতীতেও পাওয়া যায়নি, এখনও তা পাওয়া যাবে না। তবে সংবাদমাধ্যমে ঢাকা মহানগরসহ জেলাওয়ারি কিছু হিসাব বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো সামষ্টিক হিসাব পাওয়া যায় না। এ সূত্র ছাড়াও যেসব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, সেসব রাজনৈতিক দলের পর্যায়ের নেতা বা মুখপাত্র গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের সার্বিক সংখ্যা সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন। অন্যদিকে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র। এসব বাহিনী বা বাহিনীদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো সংখ্যা সাধারণত পাওয়া যায় না। বিশেষ অভিযানকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিবারণমূলক (Preventive) কার্যক্রম বলে আখ্যায়িত করে। অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যেই ব্যাপকসংখ্যক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধিতে নিবারণমূলক কার্যক্রমের সংজ্ঞা ভিন্নতর। এর জন্য ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৪৪ ধারা বলে আদেশ জারি করতে হয়। এ আদেশ জারি করার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। এ আদেশ জারি করার পর রাস্তায় মিছিল, মিটিং বা কোনো সমাবেশ করা যায় না। ১৯৭৬ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ গঠিত হওয়ার পর এ ধরনের ক্ষমতা পুলিশ কমিশনার প্রয়োগ করেন। মহানগর পুলিশের এলাকা-বহির্ভূত জেলা শহরে এখনও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষেত্রভেদে ইউএনও এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এবার অতীতে অনুসৃত নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে সম্ভবত অনির্দিষ্টকালের জন্য পুলিশ কমিশনার রাজধানীতে মিটিং, মিছিল বা সমাবেশ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সত্ত্বেও বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা রাস্তায় দলে দলে নেমেছেন। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি গ্রেফতারও হয়েছেন। আইন লঙ্ঘনের জন্যই এ ধরনের গ্রেফতার সমর্থনযোগ্য। এ সত্ত্বেও চলমান বিশেষ অভিযানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়- এক. অনির্দিষ্টকালের জন্য কি যে কোনো ধরনের সমাবেশ বন্ধ করা যায়! জানা মতে, এ ধরনের আদেশে নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করাই আইনসিদ্ধ। এ ধরনের আইন প্রয়োগের সংস্কৃতিতে প্রতিবাদ করার অবকাশ নেই। তবে আলোচ্য ক্ষেত্রে এ কথাও বলা প্রয়োজন যে, যে কোনো বিচারের রায় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হতে পারে; তবে রাস্তা বা জনপথে মিছিল-মিটিং করে ও যানবাহনের ক্ষতি করে প্রতিবাদ করা গণতান্ত্রিক প্রথা নয়। দ্বিতীয় বিষয় হলো, বিশেষ অভিযানের সময় মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেনি এমন ব্যক্তিরাও কেন গ্রেফতার হবেন। তারা তো কোনো আইন লঙ্ঘন করেননি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের গ্রেফতার করা। উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন যে কোনো দল বা জোট গণগ্রেফতারের দায় এড়াতে পারে না। এ অভিজ্ঞতা ২০০৪-০৫ সালেও হয়েছিল। ওই সময় বিরোধী দল ঘোষণা করেছিল যে, ৩০ এপ্রিল তৎকালীন জোট সরকারের (বিএনপি-জামায়াত) পতন হবে। এ ঘোষণার পর এ তারিখটি যতই কাছে আসতে থাকে, গ্রেফতারের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে। ওই সময়েও অনেক নিরপরাধ জনমানুষ দুই হাজার টাকার বিনিময়ে হাজতবাস থেকে মুক্তি পায় মর্মে খবর প্রকাশ করা হয়। বর্তমানেও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলের পরবর্তী কর্মসূচি মানববন্ধন ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ কর্মসূচিতে চার জেলা ব্যতীত অন্য কোথায়ও বাধা দেওয়া হয়নি। তবে গ্রেফতার হয়েছে ৭৯ জন। এ থেকে মনে হয় যে, গ্রেফতার প্রক্রিয়া সারাদেশে কমবেশি অব্যাহত থাকবে। রাজধানীসহ দেশের সিংহভাগ জেলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বাধা না দেওয়ার এবং অন্য কিছু জেলায় বাধা দেওয়ার বিষয়টি অনেকটা পরস্পরবিরোধী। এ সম্পর্কে কেন্দ্রীয়ভাবে কী ধরনের নির্দেশনা ছিল তা অজানা। তবে প্রশ্ন থাকে যে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেওয়া হয়। রাজধানীসহ দেশের অধিক সংখ্যক জেলায় মানববন্ধন শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হওয়ায় ধারণা করা যায় যে, নির্দেশনা ছিল অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া। জননিরাপত্তা ও রাজনীতির মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়,আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইতিবাচক না থাকলে দেশে বিভিন্নমুখী উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেই জননিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। তখনই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্ন এসে যায়। ক্ষমতাসীন দল আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে কিছু শান্তিপ্রিয় নাগরিকের অশান্তিও হয়। কারণ তারা কিছু ক্ষেত্রে আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপট ছাড়াও অতীতে এর নজির দৃশ্যমান ছিল। অভিযোগও ছিল। আইন-বহির্ভূত প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে এসব ব্যক্তি নিজস্ব ব্যক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নাম হয়। এদের ওপর শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের আস্থার অভাব হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.