ভোটের অধিকার আদায় করে নিতে হবে by মাসুদ মজুমদার

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা, সুশাসন ও মানবাধিকার নিয়ে বারবার কথা বলছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা তারা জোর দিয়ে বলছেন; সমান সুযোগ নিশ্চিত করার কথাও দীর্ঘ দিন বলে আসছেন। বাংলাদেশের সরকার এ ব্যাপারে প্রায়ই নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে, নয়তো চেনা ভাষায় কিছু কথা বলে যার কোনো সারবত্তা দাঁড়ায় না। আন্তর্জাতিক ও বিশ্ব সম্প্রদায় প্রশ্নের কোনো জবাব পায় না। ফলে ইস্যুগুলো উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। এটাই জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারের শ্রেণিচরিত্র। তারা সব কথা শোনে, অথচ ভূমিকা পালন করে নিজেদের মতো করে। তবে সময়মতো শুনতে বাধ্য হয়। সেই বাধ্যবাধকতার জন্য যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, তা এখনো তৈরি হয়নি বলেই মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। একইভাবে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভূমিকা সমর্থন করে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কথা বলে আসছে। বাস্তবে রোহিঙ্গা ইস্যু যে তিমিরে ছিল, এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও অপহরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোচ্চার হয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে সরকার ভূমিকা পরিবর্তন করেছে বলে মনে হয় না। বরং ধারা পাল্টে সরকার নিজের ভূমিকায় বহাল থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর কারণ, যে চাপ সৃষ্টি হলে সরকার তাদের কথা রাখতে বাধ্য, সেই পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। কিংবা কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে আশাতীত সুফল পাচ্ছে না। গণতন্ত্রের সব সংজ্ঞা মতো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার মান জিরোপর্যায় এসে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজ বারবার জোরের সাথে সত্যটি উচ্চারণ করেছে, বলার চেষ্টা করেছে- গণতন্ত্র চর্চার এই করুণ দশা অব্যাহত থাকলে বাস্তবে বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। বাস্তবে আলাদা হয়ে পড়লেও সরকার তেমন কোনো কার্যকর ও অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে সচেষ্ট হয়নি। এর অর্থ, সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিশ্ব সমাজকে তোয়াক্কা করে না- এমনটি নয়। বরং বাংলাদেশের সরকার জনগণের প্রতি কোনো দায়বোধ করে না। তাই বিশ্বসম্প্রদায় কী বলল, কী বলল না, তা নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। এ অবস্থায় ভরকেন্দ্র ও ভারকেন্দ্র দেশের জনগণ নয়, অন্য কোথাও, বিশ্ব সম্প্রদায় তা বুঝতে চেষ্টা করে।
যেকোনো সরকারের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটা নিজের জনগণের ওপর। জনগণকে আমলে নিলেই সব কিছু আমলে নিতে হয়। জনগণকে উপেক্ষা করলে আর কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। কারো কাছে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন ওঠে না। একটা উদাহরণ হলো- প্রশ্নপত্র ফাঁস, এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, পরীক্ষাটাই এখন একটা প্রহসন। এ ব্যাপারে সরকারের দায় কোথায়? মন্ত্রী আছেন, সরকার আছে, মন্ত্রণালয় আছে; কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি কোথাও প্রাধান্য পাচ্ছে না। কেন? এরও জবাব, দায়বদ্ধতা জনগণের কাছে নেই। একইভাবে দুর্নীতির প্রশ্নটি তোলা যায়- সর্বত্র পুকুর ও সাগর চুরির ঘটনা ঘটছে। অর্থমন্ত্রী রসিকতা করেন; কেউ কারো কাছে দায়বদ্ধ নেই। সংবাদপত্রে খবর আসছে, জনগণ জানল; সরকার দু-একটি রুটিনওয়ার্ক করল; তারপর আর টুঁ-শব্দটি নেই। কেউ কারো ব্যাপারে ঘাঁটাতে যাচ্ছে না। এই যে গা-সহা ভাব, তার কারণটা কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক। কারণ দেশে এত বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছেÑ কোনো একটিরও সন্তোষজনক সুরাহা এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য বিচার হয়নি। সরকারি দলের লোক হলে আচরণ হয়েছে একরকম, অন্য দলের হলে ভিন্ন ধরনের হয়েছে। তাই জনগণ জানে, এর শেষ কী হবে। তাই এসব ইস্যু মাথায় নিয়ে মাথা ভারি করতে চায় না। নিজেরা নিজেদের জন্য সান্ত্বনার জবাব খুঁজে নেয়। কী হতে পারে তার একটা ধারণা মগজে নিয়ে নিশ্চুপ থাকার চেষ্টা করে। যেমন- ইয়াবা, ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বাড়াবাড়ি- এসব কি এমন কোনো সমস্যা যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। মিয়ানমার সীমান্ত চিহ্নিহ্নত। তারপরও একটা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা কি এতই অসম্ভব! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারো কারো মতে, ‘ডাকাতদের গ্রামের মতো’। নিশ্চয় এর সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালরা এমন লোক যারা বখরা দিয়েই বাণিজ্য করে। ক্ষমতার বিনিময়ে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে থাকে। বাংলাদেশে অপরাধ বেড়েছে বেশুমার। একটা সাধারণ সূচক সর্বত্র। এটা কি এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়? বাস্তবে প্রশাসন, আইনের লোক, পুলিশের কোনো কোনো সদস্য, ছাত্রলীগের ক্যাডার, দলীয় ক্যাডার ব্যতিক্রম ছাড়া এসব অপরাধের জনক হয়ে গেছে। তাই মনে করা হয়, ওটাও না দেখার ভান করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বিগত কয়েক বছরে দলীয় ক্যাডাররা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। ক্ষমতার স্বার্থেই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে। জনগণের কাছে দায়হীন সরকার সবসময় একটা সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি করে। এদের লালন পালন করে। এ চরিত্রের লোক তৃণমূল থেকে ওপরতলা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এরাই ক্ষমতার পাহারাদার। সেবাখাতগুলো চালায় সরকারের লোকজন। আর কোথাও সেবা না কিনে কোনো উপায় নেই। জনগণ বিষয়টা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। কারণ বিপত্তি বাধালে সেবা পেতে অসুবিধা হবে, ক্ষেত্রবিশেষে সেবা পাবেই না। তা ছাড়া সেবা বিক্রি করে সরকার দেশ চালায়। এত সব সমস্যার মূল কারণ, জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই, কেউ নিজেকে জনগণের প্রতিনিধি ভাবেও না। জনগণের কিছু করার ক্ষমতা আছে বলেও মনে করে না। প্রায় সময়ে অভিযোগ ওঠে- থানায় অভিযোগ নেয় না, ডায়েরি করে না, অপরাধটা আমলে নেয় না, কারণ স্থানীয় প্রতিনিধি তার জানা। তিনি বখরা পান, সালাম পান; তাকে সেলাম ঠুকলে জনগণকে উপেক্ষা করলে কেউ কিছু করার নেই; বলতে গেলে তাকে উল্টো বিপদে পড়তে হবে এবং মামলাটা তার বিরুদ্ধেই রুজু হয়ে যাবে। অভিযোগ করতে এসে বিপদে পড়ার এই উটকো ঝামেলা সইতে জনগণ তখনই যায় যখন জনগণের দোহাইতে কিছু হয়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকে। তারা জনগণের কাছে দায়বোধ লালন করে আবার জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। শিক্ষকেরা এমপিওভুক্তির জন্য জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দিনের পর দিন পড়ে থাকলেন; কিছু হলো না। প্রথমে সরকার কথাই বলে না। শেষে নরমসুরে কথা বলে তাদের বিদায় করে দিয়ে সুর পাল্টে ফেলেছে। এখানেও জনপ্রতিনিধিত্বের অভাব। জবাবদিহিতার লেশমাত্র নেই। একটি জাতীয় দৈনিকের খবর : প্রতিদিন দুই শ’ যাত্রীর ফ্লাইট মিস হয়, শুধু যানজটে পড়ে। বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখে প্রচণ্ড যানজট- এটা কি ঠেকানো কষ্টকর ব্যাপার? নাকি এর সাথেও বাণিজ্য আছে? ফ্লাইট মিস হওয়া কি সাধারণ কোনো বিষয়! সরকার দেশ ও বিদেশে বলে- দুর্নীতিবাজদের বিচার হবেই। এটা কি কথার কথা, কোন কোন বড় দুর্নীতির বিচার হলো? জনগণের সামনে এর কোনো নজির তো নেই; তাই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, আসল দুর্নীতিবাজরা বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াবে। বাংলাদেশে সোনার খনি নেই। কিন্তু শুধু স্বর্ণনির্ভর ১৮ হাজার কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা চলে। এটা তো কোনো সিক্রেট বিষয় নয়। তাহলে দুর্নীতির বিচার হচ্ছে কোথায়? কোন দুর্নীতি রাজ্যের বিচার কোন দুর্নীতিবাজ করতে এগোবে- এটা তো ছোট প্রশ্ন নয়। সংসদে আলোচনা হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং ব্যাংকের লুটপাট নিয়ে, সরকার নাকি এতে বিব্রত হয়। প্রশ্ন, তারা বিব্রত কার কাছে হন, কারাইবা বিব্রত করেন। জনগণের এ ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা নেই। সব দুর্নীতি জনগণের চোখের সামনেই হয়, জানা মতে হয় কিন্তু জনগণ চোখ বুজে থাকে; কিছুই বলে না। কারণ জনগণের ভোটটা লুণ্ঠন হয়ে যাওয়াই যেখানে ঠেকাতে পারল না- সেখানে আর কিছু ঠেকাবে, সেই সাধ্য কার? এতগুলো বিক্ষিপ্ত ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছি শুধু একটা উপসংহার টানার জন্য। জনগণের হাতে আছে শুধু ভোটের অধিকার। এটা প্রয়োগ করার সুযোগ পেলেই তারা ক্ষমতাবান। তারা জবাবদিহিতার একটা অধিকার সংরক্ষণ করে। সেটা যতক্ষণ না ফিরে পাচ্ছে, ততক্ষণ জনগণ শাসিত-শোষিত-লাঞ্ছিত- বঞ্চিত হবে। এ বঞ্চনার শেষ দেখতে হলে নিজের ভোটের অধিকারটা নিজের হাতের মুঠোয় আনতে হবে। কাজটা সহজ নয়। যারা এটা কেড়ে নিয়েছে তারা জানে, জনগণ ভোটের মালিক হলে যারা ক্ষমতা চর্চা করছে তাদের লাগাম পরতে এবং জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র চলে জনগণের দোহাই দিয়ে। তাও আমাদের জনগণ বঞ্চিত হয়ে আছে। তাই মাথাকুটে মরলেও লাভ হবে না। আগে এ অধিকারটা হাতের মুঠায় আনার চেষ্টা করতে হবে, তারপর স্বপাত্রে সুপাত্রে সেটা তুলে দিন; তবেই কিছুটা সুদিন ফিরবে। নয় তো, জনগণের অধিকার সর্বত্র ভূলুণ্ঠিত হতে থাকবে। প্রশাসন শাসন করবে। সেবকরা সেবা না দিয়ে করবে জিম্মি। আর যারা দেশ পরিচালনা করছে তারা কারো কোনো তোয়াক্কা না করেই সব কিছু উপেক্ষা করে দুমড়ে-মুচড়ে পথ চলবে। আইন তারা বানাবে। আইনের ব্যাখ্যা তারাই দেবে। সেই আইনের প্রয়োগও তারাই করবে। সেখানে ভোটের মালিক জনগণ বরাবরের মতো অনুপস্থিত থাকবে- তাদের হয়ে দেশ চালাবে ক্যাডার বাহিনী। তাই দুর্নীতির সয়লাব ছাড়া অন্য কিছু আশা করে কী লাভ!
masud2151@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.