ইসমে আজমের চমকপ্রদ আবিষ্কার by স্বাধীন সেন

কৈশোরে বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে ধরনের অ্যাডভেঞ্চারধর্মী বই অনেক পড়েছি। ঋজুর নাম শুনেই কেন জানি না ওই ঋজুদার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তার একটা কারণ অবশ্যই ঋজুর সঙ্গে সুন্দরবনের সখ্য। ঋজুর ভালো নাম ইসমে আজম। এসএসসি পাস। সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করছেন সাত বছর ধরে। অমিতাভ ঘোষ আর অনু জালাইয়ের মতো লেখক-গবেষকেরা দেখিয়েছেন, সুন্দরবনে চলতে গেলে জোয়ার-ভাটার হিসাব জানা কত জরুরি। খাওয়ার পানি সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। পানি না থাকলে জীবনও থাকবে না। বাঘ-কুমিরের চাইতেও সুন্দরবনের আসল বিপদ তাকে না জেনে তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে গেলে। ইসমে আজম বাঘ খুঁজতে গিয়ে খুঁজে বের করেছেন পুরোনো স্থাপনা, ঢিবি, মৃৎপাত্রসহ নানা নিদর্শন। তিনি যে গুপ্তধন সন্ধানের মতো অ্যাডভেঞ্চার করেননি, সেটা তাঁর ছবি তোলা, তথ্য সংগ্রহ আর বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি দেখলেই বোঝা যাবে। সাত বছর ধরে তিনি খুঁজে বের করেছেন প্রত্ননিদর্শন, জিপিএস দিয়ে অবস্থান রেকর্ড করেছেন। কোমরকাদায় নেমে নেমে ছবি তুলেছেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে ও বই পড়ে সেসব বোঝার চেষ্টা করেছেন। এই জমানায় বৈষয়িক লাভের কথা বা খ্যাতিকে রেয়াত না দিয়ে তিনি কাজ করে গেছেন সতীশ চন্দ্র মিত্রের মতো করে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো মানুষ এ দেশে এই জমানায় এখন দুর্লভ। তাঁকে সালাম জানাই তাঁর নেশাসক্তি, আবিষ্কার ও গবেষণার গুরুত্বের জন্য। সুন্দরবন সম্পর্কে আমাদের নাগরিকদের ধারণা এখনো প্রধানত পর্যটকসুলভ। আমরা এ-ও মনে করি যে সুন্দরবনকে পোষ মানানো শুরু হয় পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের সময়কালে বা পরে মোগল শাসনামলে। সে সময় এই ভূমির পূর্বাংশ স্থিতিশীলতা পায় গঙ্গা নদীর (বর্তমানে ভাগীরথী/আদি গঙ্গা নদী) জলধারার বেশির ভাগ বর্তমান পথ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে। এই পূর্বাংশেই বাংলাদেশের সুন্দরবন। জঙ্গল কেটে কৃষিজমি বিস্তৃত করার মধ্য দিয়ে এ সময় সেখানে মানববসতি গড়ে ওঠে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন এই মত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ঐতিহাসিক ও ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নদীপ্রবাহের পরিবর্তনের এই সময়কাল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন ও তার ভূমিরূপের স্থিতিশীলতার দাবির ভ্রান্তি এখানে মানববসতির আদি সময়কাল নিয়ে ভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করা যায়। আমাদের আরেকটি ভুল ধারণা হলো, সতত পরিবর্তনশীল বন্যাপ্রবাহ ও কাদামাটির দেশে মানুষের পক্ষে অতীতে বসতি গড়া সম্ভব হয়নি। বন্যা সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা, বন্যা, ভূমিরূপ ও মানববসতির ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আমাদের গবেষকদের আগ্রহের অভাবও এসব ভুল অনুমান ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী। সৌভাগ্যের বিষয়, ভারতের পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশের সুন্দরবন ও সংলগ্ন ভূমিরূপ নিয়ে ভূতাত্ত্বিক, পারিবারিক ও জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় জার্নালে অভিসন্দর্ভও প্রকাশিত হয়েছে।
উপকূলবর্তী জোয়ার-ভাটার প্রতিবেশে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বনের বয়স রেডিও কার্বন (ক্যালিব্রেটেড) অনুযায়ী প্রায় ১০ হাজার বছর আগে। হলোসিন সময়কালে সমুদ্র সমতলের উচ্চতার পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা বলছে, সে সময় উপকূলরেখা আরও উত্তরের দিকে ছিল। আদি-প্রতিবেশ ও আদি-উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গবেষণাগুলো জানিয়েছে, শ্বাসমূলীয় বন মাঝেমাধ্যেই হারিয়ে গেছে, আবার বিকশিত ও বিস্তৃত হয়েছে। পলি কোথাও সরে যাচ্ছে, কোথাও সঞ্চিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে। সুপেয় আর নোনার মিশেল তৈরি হচ্ছে। এই সক্রিয় বদ্বীপের উপকূলীয় প্রতিবেশে আদি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার পানিবাহিত পলির মিশ্রণ শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সতীশ চন্দ্র মিত্র সুন্দরবনসহ এতদঞ্চলের প্রত্ননিদর্শন সম্পর্কে বিশ শতকের শুরুতেই বলে গেছেন। নিজ আগ্রহে ও উদ্যমে কালীদাশ দত্ত ও তাঁর অনুসারীরা পশ্চিম বাংলার সুন্দরবন ও সংলগ্ন অঞ্চলে দীর্ঘকাল জরিপ ও গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তাঁর এবং পরবর্তী পেশাদার প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাজের মাধ্যমে তেরো শতকের আগের অসংখ্য প্রত্ননিদর্শন ও প্রত্নস্থান আমাদের নজরে আসে। তার মধ্যে রয়েছে জটার দেউল, কঙ্কনদিঘি, তিলপি, কোরবেগ, ধোসা, গোবিন্দপুর, দেউলপোঁতা, আটঘড়া, দমদম, হরিনারায়ণপুর। এর অনেকগুলোতে প্রত্নখনন পরিচালিত হয়েছে। কোনো কোনোটি থেকে তৃতীয়-দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়ার দাবি করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। এর আরেকটু উত্তরে গেলে চন্দ্রকেতুগড়। এটিসহ অন্যান্য প্রত্নস্থান আর লিপি বিশ্লেষণ করে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও রণবীর চক্রবর্তীর মতো পণ্ডিতেরা অঞ্চলটিকে টলেমি ও বিভিন্ন গ্রিক উৎসে উল্লিখিত গঙ্গারিডাই জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা বলেছেন। অজ্ঞাতনামা নাবিকের লেখা পেরিপ্লাস অব দ্য ইরাথ্রিয়ান সি বইটিতেও (আনুমানিক প্রথম শতাব্দী) এই অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। ওই সুন্দরবন থেকে পাওয়া গেছে লক্ষণ সেনের দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্কে লিখিত দুটি তাম্রলিপি এবং একাদশ-দ্বাদশ শতকে ডোম্মনপালের সময়ের আরেকটি তাম্রলিপি। ভাগীরথীর মোহনার সাগরদ্বীপেও পাওয়া গেছে প্রত্ননিদর্শন। স্থানটি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছেও তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকায় সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস-এর পরে তেমন কোনো সামগ্রিক গবেষণাভিত্তিক বই প্রকাশিত হয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদন রয়েছে সংলগ্ন অঞ্চলের প্রত্নস্থান নিয়ে। মোদ্দাকথায়, বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে কোনো পরিকল্পিত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালিত হয়নি বললেই চলে। ইসমে আজমের জরিপে চিহ্নিত প্রত্নস্থানগুলো তাই সুন্দরবনের প্রত্নতত্ত্ব গবেষণায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এর মধ্যে প্রত্নস্থানের কমপক্ষে তিনটি গুচ্ছ—খেজুরদানা, আড়পাঙ্গাশিয়া ও সাতক্ষীরার খোলপটুয়া নদীর পাড়ে উন্মোচিত ইটের তৈরি কাঠামো—আনুমানিক নবম থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টীয় শতক বা তার পরের সময়কালের বলে অনুমান করি। ইটের আকারের ওপর ভিত্তি করে সময়কাল নির্ণয় করাকে হালের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় খারিজ করে দেওয়া হয়। মৃৎপাত্র তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য সময়কাল নির্ধারক। বেশ কিছু স্থানেই বিভিন্ন সময়ের মৃৎপাত্রের সন্নিবেশ লক্ষ করা যায়। সুন্দরবনের নিয়ত রূপান্তরপ্রবণ নদীব্যবস্থা, উপকূলীয় পলল সঞ্চয়ের পরিবেশ ও জোয়ার-ভাটা মিলিয়ে কোনো কোনো স্থানের মৃৎপাত্রগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে স্রোতে ভেসে এসে জমা হয়েছে। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও আকৃতির চুল্লিগুলোও বিভিন্ন সময়ের বলেই মনে হয়। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এসব চুল্লি লবণ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হতো। ইসমে আজম এসব চুল্লির বিস্তৃতি ও অবস্থানের বিশদ মানচিত্র তৈরি করেছেন। এসব চুল্লিসহ ইটের স্থাপনাগুলো আর অপরিবর্তিত মৃৎপাত্রের সন্নিবেশ প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সুন্দরবনের এই পরিবর্তনশীল পরিবেশেও মানুষ কমপক্ষে এক হাজার থেকে চৌদ্দ শ বছর ধরে বসতি তৈরি করছে। খেজুরদানার ইটের কাঠামোগুলো নদীতে থাকায় ভাটার সময়ই কেবল আংশিক উন্মোচিত হয়। প্রত্নকাঠামো ও চুল্লিগুলো প্রায় ৮০০ মিটার দূরত্বে একটি রেখা বরাবর বিস্তৃত। কাঠামোগুলোর ব্যবহার সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে লবণ উৎপাদনের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক উড়িয়েও দেওয়া যায় না। উপকূলীয় অবস্থান দেখে অনুমান করা যায়, পুরো প্রত্নস্থানটি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে নির্মিত ও ব্যবহৃত হয়েছিল। লবণ উৎপাদন এবং নদী ও সমুদ্রপথে বাংলা ও ভারতের পূর্ব উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর জন্য এই বসতি গড়ে উঠে থাকতে পারে। তবে বসতিটি অব্যাহতভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল, নাকি মাঝেমধ্যে পরিত্যক্ত হয়েছিল, তা বলা মুশকিল। আমার মতে, ইসমে আজম অন্তত তিনটি কালপর্বের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন: ১. নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী, পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী এবং অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান।
অনেক জায়গায় প্রত্ননিদর্শন, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে মৃৎপাত্রগুলো বিভিন্ন সময়ের। এই প্রত্নস্থানগুলো বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে মানববসতির উদ্ভব ও রূপান্তর সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ ভুল প্রমাণ করেছে। মোগল আমলের বহু আগেই এখানে মানুষ বসতি গড়েছিল। আমার অনুমান, এমন অনেক প্রত্নস্থান ও নিদর্শনই সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ছড়িয়ে আছে। কোনো কোনোটি পুরু পলির নিচে চাপা পড়েছে। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে রুপার্ট ভ্যান দ্যো নুর্ট পশ্চিম সুন্দরবনের প্রত্নস্থান ও প্রত্ননিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিহাস এবং তার সাপেক্ষে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি প্রস্তাব করেছেন, এই প্রত্নস্থান ও বসতিগুলো নিয়ত প্রতিকূল ও পরিবর্তিত পরিবেশেও মানুষের অভিযোজনের প্রমাণ দেয়। মানুষ বসতি তৈরি করছে। বসতি বারবার ধ্বংস হয়েছে এবং গড়ে উঠেছে। কখনো বিশেষ কারণে, কখনো আশপাশের অন্যান্য বসতির সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে এই রূপান্তরপ্রবণ প্রতিবেশে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশের এই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব খুঁজতে চায় না। ইসমে আজমের আবিষ্কার সেখানে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সুন্দরবন থেকে একটু উত্তরে আরও অনেক প্রাক্-মধ্যযুগীয় প্রত্নস্থানের খোঁজ সতীশচন্দ্র মিত্র দিয়ে গেছেন। তার মধ্যে আছে কপিলমুনি-আগ্রা, বড়বাড়ি, ঝুড়িঝাড়া ঢিবিসহ খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের দক্ষিণাংশের বিভিন্ন প্রত্নস্থান। পরিকল্পিত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালিত হলে এ রকম বিচিত্র প্রত্নস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এসব এলাকায়ও একসময় সুন্দরবন বিস্তৃত থাকার ভূতাত্ত্বিক আলামত পাওয়া গেছে। ইসমে আজমের আবিষ্কার কমপক্ষে নবম শতক বা তারও আগে থেকে উপকূলীয় পরিবেশে শ্বাসমূলীয় বাস্তুব্যবস্থায় মানববসতির প্রমাণ। এই বসতিগুলোর বিস্তার এবং সেগুলোর মধ্যের আন্তসম্পর্ক বুঝতে গেলে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সক্রিয় ও পরিণত বদ্বীপের অন্যান্য প্রত্নস্থানের সঙ্গে এর সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সেটি অনেক বড় কাজ। আশা করি, পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকদের নির্মোহ সমর্থনে ইসমে আজম তাঁর নিষ্ঠা, আগ্রহ ও সততার মাধ্যমে এই কাজে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবেন।
স্বাধীন সেন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.