জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, প্রকৃত জাতীয়তাবাদ হলো সেই বোধ, যেখানে ব্যক্তি রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ প্রশ্নে একাত্মবোধ করে; রাষ্ট্রের ভালোকে নিজের ভালো, রাষ্ট্রের মন্দকে নিজের মন্দ মনে করে। জাতীয়তাবাদের বোধ বিবেচনায় এবং এর ভালো-মন্দের বিচার ও স্বীকারোক্তি জাতিকে শক্তিশালী ও উজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। মন্দের গঠনমূলক সমালোচনা এবং এ থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেওয়া প্রতিটি জাতীয়তাবাদী নাগরিকের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানে ব্যক্তির কথা বলা হলেও ব্যক্তি রাষ্ট্র, সরকার কিংবা রাজনৈতিক দল থেকে আলাদা নয়। ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নাও হয়, তাতে ক্ষতি নেই। তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ জাতিবোধকে জাগাতে ও সক্রিয় করতে সহায়তা করে। মূলত এ প্রশ্নে ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলার মধ্যে সত্যিকার জাতীয়তাবোধ লুক্কায়িত থাকে। বিপরীত অবস্থা রাষ্ট্রের নিজের জন্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। সাধারণ জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের প্রকাশ না ঘটলেও অর্থাৎ ভালো-মন্দের প্রকাশবোধ না থাকলে ক্ষতি কম। কেননা, তারা হয়তো প্রকাশের কোনো ফোরাম পায় না; কিন্তু রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী গোষ্ঠী প্রকাশ না করলে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, এর সঙ্গে গণতন্ত্রেরও সম্পর্ক রয়েছে। গণতন্ত্রকে নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে বিরূপ মন্তব্য রয়েছে। কেউ গণতন্ত্রকে এতটাই অপছন্দ করে বলেছেন, গণতন্ত্রের লেবাস পরে একটি সরকার বৈরী আচরণ করতে পারে। তবে এমন সুযোগ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হতে পারে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই, মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং বারবার ক্ষমতায় আসতে হলে গণতন্ত্রের লেবাস পরে বৈরী আচরণ করা  দুরূহ ব্যাপার। যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেখানে গণতন্ত্রের উপস্থিতির পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক অথবা একনায়কতন্ত্রের প্রকাশ পাবে। সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এথেন্সে ছিল বিধায় নাগরিকদের মধ্য থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ করা হতো। তাদের বিচারে সক্রেটিসের ফাঁসি দেওয়া হয়। এমন গণতন্ত্রেরও খারাপ দিক রয়েছে। প্রাচ্যে নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সরকার যা খুশি তা যেন করতে না পারে সে জন্য ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনয়নের প্রয়োজন অনুভব করা হয়। জনগণের অধিকার আদায় এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য পার্লামেন্ট, সিনেট এবং স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটে। লক্ষ্য ছিল নিয়ন্ত্রণ আরোপ। কেননা, রাষ্ট্র ও সরকার যেন কোনোভাবেই জনগণের অধিকার আদায়ে বৈরী ও অগণতান্ত্রিক আচরণ না করে। সে অনেক আগের কথা। এখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। আগের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে, পাশাপাশি নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে; কিন্তু গণতন্ত্রের ঝুঁকির কথা যা দার্শনিকরা অনেক আগে বলে গেছেন, তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। সমস্যা দেখা দেয় যখন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক আমরা খুঁজে না পাই। প্রথমত, মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের সঙ্গে ব্যক্তির ভালো-মন্দের গভীর সম্পর্ক। কেননা, ব্যক্তি ও রাষ্ট্র আলাদা সত্তা নয়। রাষ্ট্রের ভালোকে স্বীকার না করলে রাজনৈতিক দলের ক্ষতি নেই, তবে স্বীকার না করা এক প্রকার অন্যায়। কিন্তু দোষ-ত্রুটিকে ধরিয়ে দেওয়া ও গঠনমূলক সমালোচনা করা শ্রেয় এবং তা না পারা রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার শামিল।
গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে আমরা বিকৃত ও নগ্ন সমালোচনাই বেশিরভাগ সময় লক্ষ্য করি। সরকারের সফলতাকে প্রকাশ করলে সরকার সফল ও তাদের সুনাম বৃদ্ধি পাবে- এমন ধারণা থেকে প্রশংসা করা হয় না। কিন্তু সাধারণ জনগণ কোনো না কোনোভাবে সফলতার কথা বলতে পারেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এখানে সরকারের কল্যাণ ও ভালোর দিক বিবেচনা, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদকে বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হয়। দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, বাড়ছে কর্মসংস্থানও; জনগণের সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতা  ক্রমে বিস্তৃতি লাভ করছে। কিন্তু তা স্বীকার করায় যেন কোথায় বাধা। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বীকার না করার প্রবণতা বেশি। সাধারণ মানুষের প্রকাশের ভঙ্গি ভিন্ন। কোনো ফোরাম না থাকা, সরাসরি রাজনীতি না করলেও মতাদর্শ থাকা ইত্যাদি কারণে তাদের প্রকাশভঙ্গি আলাদা। আবার কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি কারও কারও এমন বিরূপ ধারণা যে, অনেক ভালো কাজ করলেও তারা ভালো নয়। এর কারণ হতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের আদর্শ ও মতাদর্শ কোনোভাবেই পছন্দনীয় নয়। অথচ এমন আদর্শ ও মতাদর্শের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি, তখন এরই নামান্তর খুঁজে পাই। এমন আদর্শের কথা বলি, যা অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন ও ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবেব প্রকাশ ঘটায়। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র তখনই পরিপকস্ফ ও বিকশিত হয়, যখন আমরা ভালো-মন্দ এবং কল্যাণ-অকল্যাণকে নির্দি্বধায় স্বীকার করতে পারি। শুধু মন্দকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা এবং ভালোর কথা একদম না বলা সঠিক নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার কোনো না কোনো ভালো কাজ করে আসছে। যদি তাই না হতো তাহলে দেশের অগ্রগতি এতটা দ্রুত হতো কিনা সন্দেহ। কোনো সরকার বেশি কাজ করেছে, অন্যরা কম করেছে। কল্যাণ ও অকল্যাণ প্রশ্নে এমনটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে কোনো বিশেষ সরকারের অবদান বেশি এবং অনস্বীকার্য। তাদের প্রয়োজনীয়তা এতটাই বেশি, যদি আমরা এমন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। এমন সরকারের বিকল্প এমন সরকার। এখন আমাদের করণীয় কীভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পরিবেশকে শক্ত, মজবুত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায়। হাত গুটিয়ে বসে থাকা কিংবা স্রেফ গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে উদ্ভট ও অস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে কখনও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারবে না।
আমরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করব কিন্তু প্রদানকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞ হবো না, রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনার সুফল পাব কিন্তু তা স্বীকার করব না; তাহলে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হবে কীভাবে? আর মন্দ সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনা এবং গঠনমূলক উত্তরণের পথ ভাবনায় আসবে না, তাও ঠিক নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও সচেতন নাগরিককে ভাবতে হবে যদি আমরা সত্যিকারভাবে জাতীয়তাবাদকে  ধারণ, লালন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাহলে আমাদের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ধারক ও বাহকের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। দ্বিমতের অর্থ জাতিকে বিভক্ত হিসেবে দেখা। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনে কোনো দ্বিমত থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সব দিবস পালন না করা এবং কোনো কোনো দিবস নিয়ে কটাক্ষ করা  বাংলাদেশ নামক দেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা। আমাদের গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও প্রগতি; যা-ই বলি না কেন, এর প্রতিটির সঙ্গে এগুলোর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আপনি মনে-প্রাণে এগুলোকে বিশ্বাস করেন তো দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতে পারবেন। দ্বিধাহীনভাবে গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন। ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলতে পারবেন। প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তি ও সরকারকে বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোকে এমন রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। নইলে দেশ এগিয়ে যাবে আর বিরুদ্ধ চেতনায় দীক্ষিত রাজনৈতিক দলগুলো পিছিয়েই থাকবে।
অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.