মানুষ এত পাশবিক হয়! by মুহাম্মদ আমিনুল হক

এক পশু আরেক পশুকে মারতে পারে। রক্তাক্ত করে তার গোশত খেতে পারে। এ কারণে পশুকে হিংস্র বলা হয়। তবে সব পশু হিংস্র নয়। মানুষ সভ্য প্রাণী।
মানুষের হৃদয় আছে। আছে দয়ামায়া। সর্বোপরি তার আছে বিবেক ও মানবতাবোধ। এ কারণে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞানে-গুণে, রূপ-বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টির সেরা জীব বানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই সেরা জীব যাতে বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে জীব-জানোয়ারের মতো অসভ্য না হয়, তার জন্য তিনি যুগে যুগে লাখ লাখ নবী-রাসূল ও কিতাব প্রেরণ করেছেন।

এই সভ্য মানুষগুলো কি বনের পশুর মতো হিংস্র হতে পারে? তারাও কি পারে পশুর মতো একে অন্যের জীবন কেড়ে নিতে? পারে খুনের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করতে? ইদানীং বেশ কয়েকটি ঘটনা আমাদের মনে এ প্রশ্নেরই জন্ম দিচ্ছে। গত ১৯ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সিনাবহ এলাকায় পুলিশের সামনেই পেটানো হয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক নারীকে। গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিও থেকে দেখা যায়, উত্তেজিত জনতা ছেলেধরা সন্দেহে ওই নারীকে নিষ্ঠুরভাবে পেটাচ্ছে। এমনকি গলায় বাঁশ চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে তার। ওই নারীর নাম মর্জিনা আক্তার (৩৫)। তার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার তনুরাম গ্রামে। গত ২১ জানুয়ারি আরো দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায়। তাদের মধ্যে একজন নারী ও একজন পুরুষ। খবরে জানা যায়, ওই দিন সকাল ৬টায় কোনাবাড়ী এলাকায় রাস্তার পাশে বোঁচকা নিয়ে বসে ছিলেন এক নারী। এ সময় ছেলেধরা সন্দেহে কিছু ব্যক্তি তাকে গণপিটুনি দেয়। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। উত্তেজিত জনতা ওই নারীর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আশপাশে আনসার বাহিনীর পাঁচ-ছয়জন সদস্য উপস্থিত থাকলেও তারা ওই নারীকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি। ‘কেবিনের বাইরে থেকে একঝলক দেখে দৌড়ে সিঁড়ির কোণে গিয়ে কেঁদে ফেললেন আঁখির বড় ভাই। বোনের ঝলসানো চেহারা দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। মাথা থেকে মুখ পুরোটাই পুড়ে গেছে। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। চোখে অমানবিক দৃশ্য দেখা যায় না।’ গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকার চানখাঁরপুল কাজী অফিসে বিয়ে করতে এসে কোনো এক বিষয়ে বেঁকে যাওয়ায় মনির ও তার সহযোগী আঁখিকে কুপিয়ে মাথার ওপর এসিড ঢেলে পালিয়ে যায়। রাজধানী ঢাকায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেই ান্ত হননি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির এপিএস কাজল মোল্যা। ওই কিশোরীকে দুই মাস ধরে বাথরুমে আটকে রেখে প্রস্রাব পর্যন্ত পান করতে বাধ্য করেছেন কাজল মোল্যা ও তার স্ত্রী। ‘চ্যানেল ২৪’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই কিশোরীকে ধর্ষণ, গরম তেলে হাত-পা ঝলসে দেয়া, শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ থেঁতলে দেয়া ছাড়াও তাকে বাথরুমে আটকে রেখে প্রস্রাব খেতে বাধ্য করা হয়েছে। কিশোরী টিভি চ্যানেলটিকে বলেন, ‘একদিন খুব খারাপ লাগছিল। আমি আন্টির (কাজল মোল্যার স্ত্রী) কাছে পানি চাই। এরপর তিনি প্রস্রাব করে তা এনে আমাকে খেতে বাধ্য করেন।’

ওপরের বিবরণগুলো আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া অসংখ্য পাশবিকতা, বর্বরতার কিঞ্চিৎ মাত্র। মিডিয়ায় সব খবর আসে না। সব খবর ফলাও করে ছাপাও হয় না। আমাদের সমাজ দিন দিন যে পশুসমাজে পরিণত হয়ে যাচ্ছে পাশবিকতার এই গুচ্ছ গুচ্ছ খবর তাই বলে দিচ্ছে। মানুষ কতটা অধম হলে আরেকজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে। ওরা কেমন জানোয়ার যাদের হিংস্র থাবায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারীও রেহাই পায়নি। এ রকম একজন অসহায় অবলা নারীকে পিটিয়ে ও গলায় বাঁশ চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করতে পারে মানুষ! আরেক মহিলাকে তো হত্যা করা হয়েছে আরো বর্বর কায়দায়। এ যেন বর্বরতার পাল্লা। এবার আরেক নারীকে পিটিয়ে মেরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। কোন ভাষায় এই নৃশংসতার নিন্দা জানাবো? আমরা বাকরুদ্ধ। আমাদের কোনো ভাষা নেই অমানবিক ও পাশবিক বর্বরতার ধিক্কার জানানোর। আঁখির গায়ে এসিড মেরেছে তারই বন্ধু। যে আঁখিকে বিয়ে করতে কাজী অফিসে নিয়ে গিয়েছিল সেই কি না কোনো এক বিষয়ে দ্বিমত পোষণের কারণে আঁখির গায়ে এসিড মেরেছে, কুপিয়েছে। এই না হলে বন্ধু হয়! বন্ধুত্বের মোড়কে এ পশুকেই পুষছিল আঁখি এত দিন। আঁখি আর সুস্থ জীবন ফিরে পাবে না। তার পুড়ে যাওয়া চামড়া পাল্টে ফেলতে হবে। কিন্তু তার পরও কি আঁখি তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পাবে? কাজল মোল্যা এবং তার স্ত্রী কিশোরী মেয়ের সাথে যে আচরণ করেছে তাকে আমরা কী বলব? পৈশাচিকতার শেষ থাকা উচিত। মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হলো। নালিশ করতে গিয়ে কাজল মোল্যার স্ত্রীর হাতে ধর্ষণের চেয়েও বড় বর্বরতার শিকার হলো মেয়েটি। একজন নারী আরেকজন নারীকে এভাবে নির্যাতন করতে পারে? ভাবতেও অবাক লাগে। একজন নারী কিভাবে আরেক নারীর যৌনাঙ্গ থেঁতলে দিতে পারে? পানির বদলে প্রস্রাব পান করতে দিতে পারে? এ কোন জাহেলি যুগ দেখছি আমরা। নারী নির্যাতনের জন্য পুরুষেরা বরাবর এগিয়ে থাকলেও নারীরাও কম যান না। বরং কখনো কখনো পাশবিকতার বিচারে নারীরা পুরুষের চেয়েও এগিয়ে। বিশেষ করে গৃহপরিচারিকা নির্যাতনে নারীর ভূমিকা থাকে বেশি। এরা নারী নামে আস্ত জানোয়ার, নারী নামের কলঙ্ক।

পিটিয়ে মানুষ মারা এখন কালচারে পরিণত হয়েছে। যখনই মানুষ পিটিয়ে মারার খবর শুনি তখনই আতঙ্কিত হই। আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে ২৮ অক্টোবরের পল্টনের সেই বীভৎস দৃশ্য। যেখানে লাঠি দিয়ে মানুষ মেরে একদল পশু লাশের ওপর নৃত্য করেছিল। আমাদের সামনে ভেসে ওঠে নাটোরের সানাউল্লাহ বাবু, আমিনবাজারের ছয় ছাত্র কিংবা বিশ্বজিতের খুন হওয়ার দৃশ্য। এরা সবাই উন্মাদ হায়েনার মুখে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল অসহায়ভাবে। কোনো মানবতা তাদের রা করতে পারেনি। ওরা সবাই মিনতি করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু পাষণ্ডরা তাদের বাঁচার আকুতিকে কোনো পাত্তাই দেয়নি।

এ সব পাশবিক কর্মগুলো কিন্তু বন-জঙ্গলের কোনো পশু করছে না। এগুলো করছে মানুষ নামে কিছু অসভ্য প্রাণী। যাদের অনেকেরই আছে অ্যাকাডেমিক শিা। এই পাশবিকতা গভীর জঙ্গলে গিয়েও কেউ করেনি। এগুলো সংঘটিত হয়েছে রাজধানীর বুকে, বিভাগীয় শহরে কিংবা শহুরে জনপদে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে খোদ পুলিশবাহিনীর সামনে!

আমরা যে যা-ই বলি না কেন এ সব বর্বর কর্মকাণ্ডের দায় সরকার, সাধারণ জনগণ, ছাত্রসমাজ, সুশীলসমাজ, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীসহ সবার ওপর বর্তায়। সরকারের ব্যর্থতাÑ তারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। বরং কখনো কখনো তারা রকের বদলে ভকের ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের ছাত্ররা যে শিাব্যবস্থায় গড়ে উঠছে তার মধ্যেও গলদ আছে। ধর্মহীন শিাব্যবস্থা যে মনুষ্যত্বকে কেড়ে নেয় তার উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া যায়Ñ নারী নির্যাতনের রেকর্ড, বর্বর কায়দায় মানুষ খুন, শিকের গায়ে হাত তোলার দৃশ্য থেকে। যারা বিশ্বজিৎকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করেছে তারা কি অশিতি? যে মহিলা কিশোরীর গোপনাঙ্গকে বিকৃত করেছে এবং পানির বদলে প্রস্রাব পান করিয়েছে সে কি অশিতি? বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারীকে যারা হত্যা করেছে তারা কি মূর্খ? আরেক মহিলাকে যারা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে তারা কি শিার আলো মোটেও পায়নি?

আসুন আমরা সবাই বাস্তবতাকে অনুভব করার চেষ্টা করি। ঘুণে ধরা সমাজকে পাল্টানোর দায়িত্ব আমাদের সবাইকে নিতে হবে। আমরা জাহেলিয়াতের বর্বরতা আর দেখতে চাই না। দেখতে চাই না বর্বর হায়েনাদের বিকৃত উল্লাস।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

aminulhoque_iiuc@yahoo.com
       

No comments

Powered by Blogger.